‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালী ক’রে, মানুষ কর নি/’’ বলে বাঙালি জাতির উপর বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ করলেও, আদতে, বাঙালির প্রকৃত মুখচ্ছবিখানি ততটা নিখুঁতভাবে আঁকতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১—১৯৪১ খ্রি.), যতটা নিপুণভাবে পেরেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬—১৯৩৮ খ্রি.)। শরৎচন্দ্রের একেকটা গল্প—উপন্যাস যেন গ্রামকেন্দ্রিক বাঙালির গার্হস্থ্যজীবনের একেকটি প্রামাণ্য দলিল। গ্রামবাংলার জীবন এবং সমাজকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন outsider —এর অষ্পষ্টতায়, ফলে তা অপূর্ণ ও অগভীর; জসীমউদ্দীনের (১৯০৩—১৯৭৬ খ্রি.) চোখে ছিল সেঁটে—বসা প্রিয়তা—মুগ্ধতার চিরপরিচিত চশমাখানা; ফলে সেই জীবন আরোপিত সৌন্দর্যে beautified; আর জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯—১৯৫৪ খ্রি.) গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি তো গোটাটাই edited reality, ফলে তা প্রতীকায়িত ও কল্প—চিত্রকল্পময়। — বাংলাদেশের গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে নির্ভেজালভাবে এবং নিখুঁতভাবে অঙ্কনের একক কৃতিত্ব ওই শরৎচন্দ্রেরই। বাংলাদেশের পল্লীর জীবন ও সমাজ আসলে কেমন, সেটা যদি কোনো অনভিজ্ঞ, অবাঙালি বিশদভাবে জানতে ব্রতী হন, তাহলে তাঁকে পল্লীসমাজ (১৯১৬) পড়তে দিলেই তাঁর কার্যসিদ্ধি হবে। একটিমাত্র উপন্যাস পড়েই তিনি গ্রামবাংলার আবহমান জীবন ও সমাজের সমীকরণ—সূত্রটি পেয়ে যাবেন। যদিও এ উপন্যাসে বিশ শতকের প্রথমার্ধের গ্রামবাংলার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তবু এ—কথা সংশয়াতীতভাবে সত্য যে, এ উপন্যাস—রচনার শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও ছবিটার তেমন কোনো উনিশ—বিশ হয়নি— রমা, রমেশ, বেণী ঘোষালেরা সেকালে যেমন ছিল, একালেও তেমনই আছেÑ হয়তো নতুন চলনে—বলনে, এই আর কী!
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।