তাঁর নিয়তিও জীবনানন্দ দাশের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। স্বল্পায়ু জীবন- তাও খুব স্বস্তিকর ছিল বলা যাবে না। রুগ্ণতা ছিল চিরসঙ্গী। ছিল জীবিকার টানাপােড়েনও। নিজের উচ্চ পরিশীলিত রুচি ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই কোনাে কাজের জন্যে আমৃত্যু তীব্র আকুলতা থাকলেও ভাগ্য কখনােই তার প্রতি প্রসন্ন হয়নি। তবে কিছুই গ্রাহ্য করেননি তিনি। কারণ কবিতাই ছিল তাঁর একমাত্র আরাধ্য। কাব্যদেবীর পদতলে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন নিঃশর্তভাবে। আক্ষরিক অর্থেই কবিতা ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না তিনি। কিন্ত গৌণ কবিরা যখন পদকে-পুরস্কারে-রাজানুকূল্যে তাঁর সমকালকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছেন তিনি তখন টেবিলবন্দী। সঙ্গী কেবল নিঃসঙ্গতা আর রুগ্ণতার দীর্ঘ ছায়া। এইভাবে ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার’ ছিলেন বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মহৎ এই কবি । তবে যথারীতি নিভতে শুরু করেছে সার্কাসের চোখধাঁধানাে সব আলাে । সেই সঙ্গে খসে পড়ছে মঞ্চ-কাঁপানাে ক্ষণিকের কুশীলবদের যত কৃত্রিম সাজ ও হাঁকডাক। সিকদার আমিনুল হক ছিলেন সত্যিকারের এক শেরপা- যার লক্ষ্য ছিল ‘মহৎ কবিতার সমগ্রতা’র শিখরে আরােহণ। এ যে বড়াে দুঃসাহসী উচ্চাভিলাষ তিনি তা জানতেন। তা সত্ত্বেও সুদৃঢ় সংকল্প ও গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি এ কঠিন পথটিই বেছে নিয়েছিলেন নিজের জন্যে । যত দিন যাচ্ছে ততই সাদরে বৃত হয়ে চলেছেন নতুন নতুনতর প্রজন্মের কাছে অভিহিত হচ্ছেন প্রতীকী কবিতার প্রধান প্রতিনিধি, পরাবাস্তবকবিদের একজন কিংবা কবিদের-কবি প্রভৃতি অভিধায় । মহৎ কবিতার স্বাদ ও সম্মােহনকে সাবলীলভাবে নিজের করে নিয়েছেন এই কবি।
সিকদার আমিনুল হকের জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২ কাঁচরাপাড়া, কলকাতায়। পাঁচ ভাই, তিন বােনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ। শিক্ষা : স্নাতক পর্যন্ত। পিতা ছিলেন রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার, তাই শৈশব থেকে প্রথম যৌবন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বাংলাদেশের বহু স্থানে স্বল্পকালীন বাস করার অভিজ্ঞতার পরে বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা, ঢাকা। বিবাহিত। স্ত্রী ও দুই পুত্র নিয়ে ছােট পরিবার। শখ : ধ্রুপদী গান শােনা, বারান্দায় অলস চিত্তে বসে থাকা, বিশেষত রাত্রিবেলা। প্রবাসী বাঙালিদের নিমন্ত্রণে মার্কিন দেশ ভ্রমণ করেছেন একবার। তার ‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থ বাঙালি পাঠকের কাছে। চিরায়ত গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। পুরস্কার : আহসান হাবীব স্মৃতি পুরস্কার ও বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৮৫। সর্বমােট কাব্যগ্রন্থ ১৭টি। প্রবন্ধের বই ২টি। হৃদরােগের কারণে বড় অসুস্থতার পরে শল্য-চিকিৎসায় এখন খানিকটা সুস্থ। ঠাণ্ডা তাঁর নিত্যসঙ্গী। বিনয়ী, স্বল্পভাষী ও মদ স্বভাবের খ্যাতি। আছে পরিচিত মহলে। ধর্মবিশ্বাস প্রবল, কিন্তু তা ব্যক্তিগত চর্চা ও উপলব্ধির বিষয় বলে মনে করেন। কেতাদুরস্ত পােশাক ও খাদ্যে বিলাসিতা থাকলেও সামাজিকতায় অপটু, সম্ভবত। সে-কারণেই ভিড় ও সংঘে খুব বেশি স্বস্তি পান না।... মৃত্যুচিন্তা তাঁর প্রিয় বিষয়।