'পথের পাঁচালী': পাঁচটি চরিত্র অপু: 'অপরাজিত উপন্যাসে যে কিশোর ও যুবক অপুর ছবি আঁকা হয়েছে 'পথের পাঁচালী'-তে তার সূচনা মাত্র আমরা পাই। অপুর শৈশব এ উপন্যাসের একমাত্র না হলেও সর্বপ্রধান উপজীব্য। তার চরিত্রে অসাধারণত্ব আছে সত্য, কিন্তু সে বাংলাদেশের সাধারণ পল্লীশিশুও বটে। অপুর সাধারণত্বেও প্রমাণ আমরা পাই তার চালভাজা বা পান্সে পায়েস খাওয়ার অবোধ আনন্দে, তাজবিবির ছবি দেখার আগ্রহে, বাবার অনুপস্থিতিতে লেখাপড়া ফেলে গুলি খেলতে বেরিয়ে পড়ায়, সামন্য সামান্য খাদ্যবস্তু বা বুনো ফলমূলের প্রতি লোভের অতিশয্যে-দেখলেই মনে হয়, একে তো আমরা চিনি, পাড়াগাঁয়ের পথে- ঘাটে একে তো বহুবার দেখেছি। আর তাকে অসাধারণ করে তুলেছে তার কল্পনাপ্রবণ সৌন্দর্যদৃষ্টি। সে যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রার ঘটনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, সান্ন্যাল মহাশয়ের দেশভ্রমনের গল্পের প্রত্যেকটি কথা 'যেন দুর্ভিক্ষের ক্ষুধার আগ্রহে' গিলতে থাকে, 'সর্বদর্শন-সংগ্রহ' পড়তে পড়তে মনে মনে পারা ভরা শকুনির ডিম মুখে পুরে আকাশে উড়ে বেড়ায়! সবচেয়ে বড় কথা, এই অসাধারণ কল্পনাপ্রবণতাই তাকে নিশ্চিন্দিডুরের নিসর্গ-স্বর্গের অন্তর্লোকে প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছে, এইগুণেই সে হয়ে উঠেছে। "অর্ধেক মানব আর অর্ধেক প্রকৃতি"। অপু নিশ্চিন্দিপুরকে ভালোবাসে-কিন্তু নিশ্চিন্দিপুরের এই আকর্ষণ গ্রাম বাংলার কোমল-নির্সগ-সৌন্দর্যর আকর্ষণ মাত্র নয়। অপুর কাছে নিশ্চিন্দিপুরের গ্রামজীবনের প্রতীক-স্থানীয় বস্তু নয়। ঠিক অপু যেমন অপু অন্য কেউ নয়, তেমনি নিশ্চিন্দিপুরও একটা বিশিষ্ট বস্তুসত্তা ও ভাবসত্তা-বাংলাদেশের যে কোন একটা গ্রাম মাত্র নয়। বিভূতিভূষণ প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন, তাঁর অপুও প্রকৃতি-প্রেমিক-পরবর্তী জীবনে বিশ্ব-প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছে, অভিভূত করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর ও নিশ্চিন্দিপুরের নিসর্গের যে সম্পক তা ওয়ার্ডসওয়ার্থীয় প্রকৃতি প্রেমিকের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্পর্ক মাত্র নয়। এ সম্পর্ক একান্তভাবে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক-জননী ও সন্তানের সর্ম্পকের মত, প্রেমিক ও প্রেমিকার সর্ম্পকের মত গোপন ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক mystric, csoteric সম্পর্ক। সব গ্রাম অপুর ভালো লাগে না, কারণ সব গ্রাম তো নিশ্চিন্দিপুর নয়। 'অপরাজিত' উপন্যাসে মনসাপোতা গ্রাম সম্বন্ধে কথাটি বেশ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে "অপুর কেমন মনে হয় নিশ্চিতপুরের সে অপূর্ব মায়ারূপ এখানকার কিছুতেই নেই।"
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।