বিন্দু? বিন্দুর স্বামীর কাছে ফেরার গোপন আগ্রহের অভার ছিল না, তার চেয়েও বড় কথা বিন্দু নন্দলালের বাড়ি গিয়ে ওঠার প্রস্তাবে রাজি হলো না। সেই পুরনো বাড়িতেই রইল। এ কি কয়েক বছরের চাপিয়ে-দেয়া অভ্যাসের বন্ধন, অথবা অন্যতম জীবনের তৃষ্ণা? মনের যে বৃত্তি একদিন জাগিয়েছিল, বছরের পর বছর লালন করেছিল নন্দলালের জন্য, আজ তা আর জীর্ণ বস্ত্রের মতো ফেলে দেয়া সম্ভব হলো না। মানুষের স্বভাব তার ইচ্ছাধীন নয়। নন্দলালকে যেভাবে অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্যে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয় তাতে তার মনে মনে ক্রুদ্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠার কারণ ছিল। সে অবশ্য ভিতর থেকে বিন্দুর প্রতি কিছু আকর্ষণ অনুভব করেছিল, না হলে ফেলে রেখে চলে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল-যা সে নেয়নি। সে বলেছিল, বিন্দু তাকে ছলাকলা দিয়ে ভুলিয়েছিল। তাই তার জন্য শান্তির ব্যবস্থা। তারপর একদিন যখন হঠাৎ সে চলে গেল, যতই রাগ দেখাক ভয় দেখাক, নন্দলাল অনুভব করল বিন্দুকে তার চাই, না হলেই নয়। বিন্দুকে সে সংসারে নিয়ে যেতে চাইল গৃহিণীর মর্যাদা দিয়ে। কিন্তু গেরস্তঘরের মেয়ে সেই বিন্দু আর বেঁচে নেই। যা এককালে ছিল পরম কাম্য তাতে আর তৃপ্তি নেই, আগ্রহ নেই। কে কোথা থেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে মানুষের মন? শশীর দায় কিছু ছিল কি বিন্দু-নন্দলালের ট্রাজেডিতে? শশী বিন্দুকে নিয়ে এসেছিল, ভেবেছিল অপমান থেকে বাঁচাল। কে কাকে বাঁচায়? শশী মনের গভীরে অনুভব করছে তার স্বাধীন সক্রিয়তা ব্যর্থ হয়ে গেল। নন্দলাল বিন্দুকে কি চেয়েছিল, কে কি পেতে চেষ্টা করল-কিভাবে নিজের মনের বন্ধনে জড়িয়েই তলিয়ে গেল। শশীর জীবনকে তোলপাড় করে না দিলেও তার মননকে ভিতরে ভিতরে গ্রস্ত করল।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।