মুখবন্ধ ‘শয়তান গ্রহ’ মুকুলের গভীর বেদনা ও কল্পনার উচ্চাঙ্গ জীবন যা দেয় সাহিত্যকে কখনো কখনো তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, কিন্তু সাহিত্য কখনো কাউকে ঠকায় না, বরং পরিপূর্ণ করে, পরিতৃপ্ত করে। চিন্তা ও চেতনারেখায় একমুঠো আলো ঢেলে দেয়, স্বপ্ন ঢেলে দেয়। অসঙ্গতি ও অনিয়মের মুখে ঝামা ঘসে দেয়। প্রতিদিন সমাজ অসঙ্গতির কোষ প্রশস্ত হচ্ছে। আমরা চিৎকার করছি। ভেতরে-বাহিরে আমরা গভীরভাবে চিৎকার করছি সবসময়। সবার চিৎকার করার ধরণ এক নয়, ভাষাও এক হয় না, ভিন্ন। লেখক মনিরুল ইসলাম মুকুল তার ‘শয়তান গ্রহ’ গ্রন্থে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অসঙ্গতি কল্পনার রঙ-তুলিতে আঁকার চেষ্টা করেছেন, বর্ণের সাদা-কালো ছাচে রঙিন করে তোলার চেষ্টা করেছেন। এরকম সাহস সব মানুষের থাকে না। কারও কারও থাকে। সেই স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে মুকুল একজন। ব্যক্তি মুকুল একজন সংগ্রামী ও সাহসী মানুষ। জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাঁকে সমাজ-সংসারের অনেকগুলো সংকটাপন্ন অলিগলিতে নিয়ে গেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। জীবন-অভিজ্ঞতা ও সংকট তাকে ক্রমান্বয়ে স্বপ্নবাজ করে তুলেছে। সংকটকে সম্ভাবনায় পরিণত করার অসম সাহস ও শক্তি নিয়ে লেখক তাঁর জীবন ও লেখনি দু-টোই এগিয়ে নিয়েছেন। সাহিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি। মূলত মনিরুল ইসলাম মুকুলের ‘শয়তান গ্রহ’ আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের চারপাশের প্রতিচ্ছবি। মুকুলের ‘শয়তান গ্রহ’ গ্রন্থের পাÐুলিপি পড়তে শুরু করলাম ক’দিন আগে। শয়তান গ্রহ আমাকে টানতে টানতে এক গভীর কল্পরাজ্যে নিয়ে গেলো। আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম এক নতুন অজানায়, নতুন মাত্রায়। এই গ্রন্থের গল্পগুলো অন্যরকম। গল্পের গাঁথুনি, গল্পের টান, গল্পের মায়া কেমন যেনো সম্মোহনের দরজায় নিয়ে যায়। এর সাহিত্য মানও নিতান্তই মন্দ নয়। লেখার কোনো কোনো অংশে বড় লেখার প্রতিচ্ছবিও ভেসে ওঠে। অধিকাংশ গল্পে লেখক রম্য করে আমাদের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নানাভাবে বোঝাতে চেয়েছেন অপেক্ষাকৃত অযোগ্যদের হাতেই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজযন্ত্রের চাবিকাঠি। লেখক তাঁর লেখায় সমাজ-দুষ্টুচক্রকে চিহ্নিত করার, ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আর নিপুণ সাধনা সেই কাজে তাকে অনেকটা সফল করেছে। ভাষার সারল্য এই লেখার এক অন্যরকম বৈশিষ্ট্য। প্রবহমানতা ও নিবিড় আকর্ষণ লেখার সাথে পাঠকের এক নিবিড় অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সৃষ্টি করবে। পাঠককে কখনো থামিয়ে দেবে, কখনো ভাবাবে, কখনো বা কল্পলোক ও বাস্তবতার দরজায় কড়া নাড়বে। ছোটগল্প প্রসারতায় ছোট, কিন্তু এর রস ছোট নয়, আবেগ ও আহŸান ছোট নয়। একটি বিশেষ ঘটনা অথবা মুহূর্তকে নিবিড় আকর্ষণে ফুটিয়ে তুলতে পারা এক অসাধারণ যোগ্যতা। প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ, হাস্যরসাত্মক কিংবা ঐতিহাসিক বিষয় সাধারণত ছোটগল্পে ফুটে ওঠে। শয়তান গ্রহে সংকেত ও প্রতীক উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। সহজপাঠে প্রকাশ না করে ভিন্ন অর্থ ও ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করা হয়েছে। ছোটগল্প সাধারণত এক চরিত্র কেন্দ্রিক হয়। ‘শয়তান গ্রহ’ অনেকাংশেই এক চরিত্র কেন্দ্রিক। ছোটগল্প স্বল্প সংলাপ ধারণ করে। তবে এই গ্রন্থের গল্পগুলো কোথাও কোথাও সংলাপনির্ভর মনে হয়েছে। তবে বিষয়বস্তু, লেখার মান ও ধরণ পাঠককে ভাবতে, ভাবাতে ও রস সঞ্চার করতে যথেষ্ট সফল বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। গল্পগুলো তীব্র ¯্রােতমুখি ও গতিশীল। ছোটগল্পের শুরু ও শেষে যে অতৃপ্তি থাকবার কথা শয়তান গ্রহের গল্পগুলো সেই অতৃপ্তি দিতে অনেকাংশেই সফল। ফলে, সাহিত্য মানবিবেচনায় এই গ্রন্থ সফল ও সঠিক ধারায় প্রবহমান। মনিরুল ইসলাম মুকুলের শয়তান গ্রহের সফলতা ও ব্যর্থতা পাঠক নির্বাচন করবেন। তবে আমার বিশ^াস পাঠকের সময় নষ্ট করবে না শয়তান গ্রহ। গ্রন্থটি আমাদের বোধের দরজায় কঠিন আঘাত হানবে বলেই আমার বিশ^াস, আমাদের অশুভ হরণের অস্ত্রে আরও শান দেবে বলে আমার বিশ^াস। গ্রন্থটি লেখকের অন্যান্য লেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করবে বলে আমার বিশ^াস। মুকুল এক অসাধারণ সম্ভাবনাময় তরুণ লেখক। তাঁর কল্পরাজ্য, তাঁর স্বপ্নরাজ্য, তাঁর বিপ্লব ও বিরোধিতার জায়গাগুলো আরও প্রশস্ত হোক। উমর ফারুক লেখক ও শিক্ষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর