পাঠরোধক ১. খোনা কিংবা তোতলা যখন কথা বলে তখন সবার হাসি পায়। খোনার কথায় হাসি পায় তার নাকা স্বরের কারণে। আবার, তোতলার কথায় হাসি পায়, কারণ, কথা বলার সময় তোতলার জিহ্বা আটকে যায় উচ্চার্য কোনো একটা শব্দের শব্দাংশের উপর, একই শব্দাংশ বা অক্ষর বা ধ্বনি বারবার উচ্চারিত হতে থাকে। ধ্বনিটা তার জিহ্বাকে ধাক্কা দিতে থাকে বের হবে না বলে, তার জিহ্বা ধ্বনিটাকে ধাক্কা দিতে থাকে ধাক্কিয়ে বের করার জন্য। এভাবে, তোতলা নির্দিষ্ট অক্ষরের বা ধ্বনির আঠায় আটকে যাওয়া জিহ্বাকে মুক্ত করে আরেকটা অক্ষর বা ধ্বনি উচ্চারণের পথে নিয়ে যাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু জিহ্বা আর সহজে এগোয় না। এই চেষ্টার ফলে তৈরি হওয়া মুখমণ্ডলের অস্বাভাবিক বিকৃতি ঘটে, এ বিকৃতি শ্রোতাকে শুধু শ্রোতা করে রাখে না দর্শকও করে তোলে আর হাসির উদ্রেক করে আরো। শ্রোতারা খোলা হাসি হাসে, চাপা হাসি হাসে বা হাসি চেপে রাখতে চেষ্টা করে [চেষ্টার গা থেকেও হাসির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখা বের হয়ে আসে]। মানুষের এসব খোলা হাসি বা চাপা হাসি বা চাপতে চাওয়া হাসি খোনা বা তোতলার জন্য মারাত্মক নিগ্রহের মতো। নিগ্রাহকদের নিগ্রহ থেকে মুক্ত হবার জন্য, স্বাভাবিকভাবে কথা বলার জন্য আরো মরিয়া হয়ে ওঠে তারা এবং আরো বেশি করে তোতলামি এসে হাজির হয় তাদের জিহ্বাতে। তোতলার নিজ জিহ্বায় তার নিজের জন্য নির্মম হয়ে যায়। কিন্তু বোবা যখন কথা বলে তখন তার জন্য একধরনের ব্যথা অনুভূত হয় শ্রোতার মনে। এ অনুভূতির কারণ, বোবা যখন কথা বলে তখন সে ‘গোঁ-গো’ঁ করা ছাড়া আর কোনো শব্দ করতে পারে না, শব্দ দিয়ে একবিন্দু ভাবও প্রকাশ করতে পারে না। ‘গোঁ-গোঁ’ করার সময় তারও মুখ চোখ ঠোঁটের বিকৃতি হয় কিন্তু সেই বিকৃতিতে নিষ্ফলতার বেদনা পায় শ্রোতা। খোনা বা তোতলার মুখের বিকৃতি থেকে বোবার মুখের এ বেদনামাখা বিকৃতির প্রকৃতি আলাদা। খোনা বা তোতলা তার মনের ভাব বোঝাতে পারে, শ্রোতাও বুঝতে পারে। কিন্তু বোবার ক্ষেত্রে সেটা হয় না, এক্ষেত্রে দুটো নিষ্ফলতা এক হয়Ñ এক. বোবার বিন্দুমাত্র শব্দ (ওয়ার্ড) উচ্চারণ করতে না পারা, দুই. শ্রোতার লেশমাত্র বুঝতে না পারা। শ্রোতার না হাসতে পারার আরো একটা কারণ হতে পারে, বোবার শ্রোতা বোবার মুখভঙ্গি দেখে আর ‘গোঁ-গোঁ’ শব্দের উচল-নিচল ভাব বুঝে তার কথার মর্মোদ্ভেদ করতে, তার বেদনা বা আনন্দ বুঝে নিতে সকল শক্তি নিয়োগ করে ফলে হাস্য-শক্তি প্রকাশ হবার সুযোগ পায় না। বোবা কি কথা বলে না? বলে। সে যখন আনন্দ পায় তখনও কথা বলে, যখন ব্যথা পায় তখনও বলে। মানুষ বুঝুক বা না বুঝুক। অবশ্য বোবার ভাষা যে, কেউই বোঝে না এমন নয়, বোবার প্রতি যারা মনোযোগী তারা বোঝে। এ গ্রন্থের কিছু কবিতা বোবা। সেগুলোর জন্য ব্যথা পাওয়া যেতে পারে। কিছু কবিতা খোনা বা তোতলা, সেগুলো হাসির উদ্রেক করতে পারে। হাসবেন, উদ্রিক্ত হাসি চেপে রাখার দরকার নেই। আপনার হাসি শুনে কিছু কবিতা তাদের কান জুড়োতে পারবে। এ বইতে কিছু কালা কবিতাও রইলো। আপনার দীর্ঘশ্বাস বা হাসির শব্দ শুনতে পাবে না। ২. বাপ-মায়ের আগ্রহেই সন্তানেরা সাক্ষর। আমিও। পরবর্তীকালে আমার খুব ইচ্ছে করেছে নিরক্ষর হতে। মনে হতোÑ যদি কোনোভাবে আবার নিরক্ষর হতে পারতাম বেশ ভালো হতো। কিন্তু জানি, শত চেষ্টা করলেও কোনো সাক্ষর লোক আর নিরক্ষর হতে পারবে না। যারা বহুদিন ধরে অক্ষরপোকা দিয়ে খাইয়েছে নিজেদের হৃদয় তাদের পক্ষে নিরক্ষর হওয়া সম্ভব না। সেসব সাক্ষর লোকও নিরক্ষর হতে পারবে না, যাদের হৃদয়ে অক্ষরেরা স্বাক্ষর করে ফেলেছে গভীর আঁচড়ে। যদিও অক্ষরে অক্ষরে কিছু মহৎমধু ঢুকেছে ভেতরে, সাথে সাথে ঢুকেছে বিস্তারিত বিষও। নিরক্ষর থাকার স্বাদ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে গেছি। বঞ্চিত হয়ে গেছি, শুধু দেখে এবং পরশ করে এবং গাছের গায়ে কান রেখে তাদের আনন্দ বেদনা বুঝে নেবার স্বাদ থেকে। বঞ্চিত হয়ে গেছি, জলের বুকে কোন বেদনায় বা আনন্দে ঢেউ জাগে তা বুঝে নেবার স্বাদ থেকে। বঞ্চিত হয়ে গেছি, পাথরের বুকের ঠিক কোন জায়গাটাতে এত নিশ্চলতা লুকিয়ে থাকে, শীতলতা লুকিয়ে থাকে বা উত্তাপ-লতা লুকিয়ে থাকে তা বুঝে নেবার স্বাদ থেকে। অক্ষরেরা এসব গাছ-পাথর-মাটি-জল-সম্পর্কীয় অনুভূতি আমাদের হৃদয়ে উপস্থাপন করে অক্ষরদেরই রুচি আর বোধ অনুসারে। এ গ্রন্থের কবিতাগুলোকে আমি পাঠযোগ্য কবিতা বলি না। এগুলো যতটা না পঠনযোগ্য তার চেয়ে বেশি দেখনযোগ্য। শরীরসর্বস্ব কবিতা এগুলো। শরীরসর্বস্ব কবিতা বলেই এ বইয়ের নাম শরীরীয়ত শরীরীয়া। কোনো কোনো মানুষ যেমন নিরক্ষর হতে পারে, অশিক্ষিত হতে পারে; তেমনই নিরক্ষর, অশিক্ষিত কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম। কবিতাগুলোকে পুরো নিরক্ষর বা অশিক্ষিত করা গেল না হয়তো। অভিলাষ লাস হতে পারল না, অভিলাষ লাশ হয়ে পড়ে থাকল। তবু এসব থাক, অশিক্ষিত কবিতা তৈরির একটা চেষ্টন হিসেবে। ৩. কৈশোর পেরোনোর পর প্রবল এক ইচ্ছে জেগেছিলÑ আমি আমার জিহ্বা কেটে ফেলব, যাতে আর কথা বলতে না হয়, কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে না হয়। ইচ্ছে হয়েছিল, কখনোই আর কথা বলব না, কিন্তু লিখব ইচ্ছেমতো। নিজে থেকে জিহ্বা কাটার কোনো উদ্যোগ নিতে পারিনি। জিহ্বা কাটতে উদ্যোগী হবার আগেই জিহ্বা কাটার সময় সীমাহীন ব্যথা জাগবে, লহমায় ছুটে যাবে লোহুর বান Ñ এ বোধ চেপে ধরত। এবং ব্যথাহীনভাবে জিহ্বা কাটার কোনো পদ্ধতি আমার জানা ছিল না। নিজের ইচ্ছের কথা গোপন করে কয়েকজন শল্যচিকিৎসকের কাছে জানতেও চেয়েছিলাম কেউ যদি জিব কাটতে চায় তবে ডাক্তাররা তাকে কীভাবে সাহায্য করবে?’ তারা কেমন করে জানি বুঝে গেছিল, জিহ্বার লাশ ফেলার অভিলাষটা আসলে আমারই। তাদের বক্তব্য ‘আপনি কথা বলা বাদ দেন এতেই তো হবে। জিহ্বা ফেলার দরকার কী?’ কিন্তু জিহ্বা আছে আর কথা না বলে থাকব এটা কী আর হয়! লোকেই গুঁতিয়ে-গুঁতিয়ে কথা বলিয়ে ছাড়বে, নিজের ভেতরের কথায় গুঁতোগুঁতি করে জিহ্বাযানে চড়ে বেরিয়ে পড়বে হাওয়া খেতে, ঢুকে যাবে মানুষের কানে কানে মানুষের কান খেতে। জিহ্বা-বিচ্ছেদী না হতে পারার বেদনা এখনো আছে। মনে হয়, জিহ্বাহীন হবার যাদের বাসনা হয়Ñ তারা যদি তা না করতে পারে তবে তারা গৃহচ্যুত হয়, বনয়ারি হয়, সন্ন্যাসী হয়। আমি কোনোটাই পারিনি। নিজের জিহ্বাও ত্যাগ করতে পারিনি, বনবাসীও হতে পারিনি; দুয়ের খাঁজে পড়ে আছি কিন্তু এ গ্রন্থে কিছু কবিতা আছে যেগুলো জিহ্বাহীন মানুষের মতো। ৪. পাগল আপন মনে আবোল-তাবোল কথা বলে চলে, আবোল-তাবোল কথার শাবল চালায় যেখানে-সেখানে, যখন-তখন। মানুষ হাসে। কিন্তু কখনো কখনো তার কথার ভেতর এমন কিছু কথা থেকে যায় যে কথাগুলো মহান সব দার্শনিকের কথার মতোই উচ্চমানের, উচ্চগ্রামের, উচ্চবোধের। এ বইয়ের কবিতাগুচ্ছের কিছু কবিতা এমন পাগলাটে। পাগল কবিতা। ৫. বিচিত্রকর্মা আর বিচিত্রবর্ণা মেঘমালার ভেসে বেড়ানো, চিমনির বা সিগারেটের ধোঁয়া অথবা কেতলির মুখ হতে বের হওয়া বাষ্প দেখে অথবা বরফের গা থেকে ঠান্ডা বাষ্প বের হওয়া দেখে যেমন মনে হয়, ঐ একটা ঘোড়া উড়ে যাচ্ছে অথবা ঐ একজোড়া রাজহংস-রাজহংসী সাঁতার কাটছে পাথার জলে অথবা ঐ একজন নটী নিখুঁত মুদ্রায় নৃত্য করছে বাঁকা উঠোনেÑ শূন্য উঠোনেÑ ফাঁকা উঠোনে। এমন আরো নানা চিত্র ভেসে ওঠে। এসব চিত্র হয়তো মানুষকে কিছু বলতে চায়। আবার, গাছের লতার আঁকাবাঁকা ডালপালা, কাঁটা-মালা দেখে মনে হয়, এগুলো হায়ারোগ্লিফিক এবং/বা কিউনিফর্ম বর্ণমালার আদি উৎস; যা পাঠ করা যায় না। কিন্তু এসব ইঙ্গিতবহ গাছপালা, মেঘমালাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক অক্ষরে-বর্ণে গঠিত শব্দবাক্য পাঠ করতে পারলে দারুণ কিছু পাওয়া যেতে পারত। কিন্তু আমরা এমনই নিরক্ষর যে, গাছপালার আঁকাবাঁকা শাখা-প্রশাখার বর্ণমালা-শব্দমালা-বাক্যমালা-বোধমালা পড়তে পারি না, বুঝতে পারি না। উঁচু গাছের টুই থেকে একটা পীত পাতা যখন ঝরে পড়ে তখন পড়ন্ত পাতার গতির মধ্যে যে অপূর্ব নৃত্যভঙ্গিমা তৈরি হয়, নৃত্যের যেসব মুদ্রা তৈরি হয় সেসব বুঝতে পারি না। কেউ-ই যে পারে না, তা না, কেউ কেউ কিন্তু ঠিকই পারে। আবার, মেঝেতে পড়ে যাওয়া জগের জল বা মগের দুধ বা দেহের কাটা রগের রক্ত বা যে-কোনো তরল পড়ে গেলে অনেক রকম ছবি তৈরি হয়। তরল পড়ে যেসব ছবি তৈরি হয় সেগুলোকে বিভিন্নরকম ভৌগোলিক মানচিত্রের মতো, প্রাণীর মতো, বস্তুর মতো লাগে। গড়িয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে যাওয়া এসব তরল সবসময়ই কোনো না কোনো ছবি দেয়ই। বেশিরভাগ সময় দেয় বিমূর্ত ছবি কিন্তু কোনো কোনো সময় এমন স্পষ্ট মূর্ত ছবিও দেয় যা যে-কোনো চিত্রকর বহুবছর ব্যয় করে বহু চেষ্টা ব্যয় করে আয়ত্ত করতে পারে। এ গ্রন্থের কিছু কবিতার বুকের দিকে, পিঠের দিকে, শব্দের দিকে বা বাক্যের দিকে তাকালে সময়-তরল গড়িয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া চিত্রের মতো মনে হতে পারে। স্পষ্ট কোনো ছবি দিতে পারে না বেশিরভাগ সময়Ñ এক আধবার পারে। ৬. এ বইয়ের কবিতাগুচ্ছের বেশিরভাগই বানিয়েছি, বুনেছি, লিখেছি, এঁকেছি ২০০২-২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময়রেখার বাইরে আছে তিনটি; যেমন, এখানে ঠাঁই পেয়েছে ‘পৃথিবীর প্রথম কবিতা’ শিরোনামে খ্রিষ্টীয় ১৯৯১ সালে লেখা জীবনের প্রথম লেখাটি। ‘পৃথিবীর প্রথম প্রকাশিত কবিতা’ নামে ১৯৯৮ সালে লেখা একটা লেখা আছে; লেখাটি আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা যা একটা কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ডপত্র’র নামকরণ করার খসড়াটিও আছে। এ বইয়ের প্রথম কবিতাটি খ্রিষ্টীয় ২০০৩ সালে লেখা এবং আমার খুব প্রিয়; এ কবিতাটিই এ গ্রন্থের চক্ষু, ফুসফুস এবং হৃদয়। লেখাটি সম্ভবত সে-ই বছরেই বা কিছু পরে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকার সাহিত্যসাময়িকী ‘সুবর্ণরেখা’য় প্রকাশ হয়েছিল। এ গ্রন্থের আরও দুএকটি কবিতা হয়তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কিন্তু বেশিরভাগই কখনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি; কারণ, এদের অঙ্গগত জটিলতা। ৭. আবার বলে নিচ্ছি, এই পুস্তিকার কবিতাগুলোতে লেখার চেয়ে রেখা বেশি, অঙ্কের চেয়ে অংকেত বেশি, স্পষ্টতার চেয়ে সংকেত বেশি। এসব পাগলাটে, বোবাকালা, খোনা-তোতলা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী কিছু কবিতা এ বইতে রাখলাম স্মারক হিসেবে আর অনেকগুলো ফেলেও দিলাম চুলার জিহ্বায়। পাঠরোধক পার হলেন। আর এগুবেন কি না ভেবে দেখুন।