প্রথম ফ্ল্যাপের লেখাঃ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কেবল একজন সংগঠক নন, ভাবুক বা চিন্তক নন, সমাজহিতৈষী নন, সম্পাদক নন, শিক্ষক বা বক্তা নন, তিনি একজন সৃষ্টিশীল লেখক। তিনি কবি এবং তিনি ফিকশন-লেখক। তিনি গল্পকার। প্রত্যাবর্তনহীন তাঁর লেখা ছয়টি গল্পের একটি চমৎকার সংকলন। এই গল্পগুলোয় আধুনিক মানুষের প্রধানত বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারার বহুবিচিত্র দিক, বিশেষ করে মানুষের মনের রহস্যময় অন্ধিসন্ধির ওপরে আলো ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের মনের কিংবা প্রবৃত্তির অন্ধকার দিকগুলো দেখে আমরা আঁতকে উঠতে পারি। 'ঘের' গল্পে তরুণী গৃহপরিচারিকাকে ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি দিয়ে ঘিরে ফেলে কামুক গৃহকর্তা : নিম্নবিত্তের নারীর মুক্তি কোথায়? অসাধারণ গল্প ফুল ও বস্তির গল্প।' একটা ফুলের সৌন্দর্য আস্বাদন ও অধিকার করার জন্য একটা বস্তির ছেলে জীবনবাজি রাখতে পারে! ‘শঙ্খিনী' গল্পটি পড়লে আমরা সেই প্রসঙ্গ পাব, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু গল্পে যেটিকে উপজীব্য করা হয়েছে; বুদ্ধদেব বসুর অনুকরণে বলতে পারি, নর-নারীরা বহুগামী, কিন্তু তারা জানুক যে তারা বহুগামী। 'লিপ্সা' গল্পে এক বাবা তাঁর যুবতী কন্যাকে বিদেশে চাকরির জন্য পাঠাতে চান, সেখানে নারীরা লাঞ্ছিত হয়, তা শুনে বাবা বলেন, 'ঐ দেশের এক হাজার টাকা যে আমাগো দেশের তেইশ হাজার টাকা!’ ‘প্রত্যাবর্তনহীন গল্পটিতে বিদেশে পড়তে যাওয়া দেশপ্রেমিক বাঙালির দেশে ফেরার আকুলতা এবং শেষ পর্যন্ত আশাভঙ্গের দোলাচলে বিবৃত। “ফিরে চল’ বরং ফেরার টানটাকেই বড় করে দেখায়, 'কেউ যদি কিছু না দেয়, চৈত্রমাসের ঘাসের উপরে হুতিয়া আস্তে আস্তে দেশের মাটির লগে মিশিয়া যাইতাম। কথাসাহিত্য আসলে আমাদের অস্তিত্বের বহু অকথিত অপ্রকাশ্য অন্ধকার অঞ্চলকে তুলে ধরে। মিলান কুন্ডেরার ভাষায় : এক্সপেন্টারার অব এক্সিসটেন্স। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গল্পও অস্তিত্বের পরিব্রাজক এবং আবিষ্কারক। —আনিসুল হক
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।