"বর্তমান সংগ্রহে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত নজরুলকেই বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে, পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা না থাকলে, জনপ্রিয় কবিতাগুলো বাদ দেয়া হয়নি। আমরা গুরুত্ব দিতে চেয়েছি বিপ্লবী নজরুলকে। বিদ্রোহী অভিধার প্রবল-প্রতাপের কারণে নজরুলের সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব বেশ খানিকটা আড়ালে পড়ে গেছে বলেই মনে হয়। এই মনে হওয়াটা কবিতার নির্বাচনে খানিকটা ভূমিকা হয়ত রেখেছে। প্রেমের কবিতা বাছাইয়ে প্রাধান্য পেয়েছে অসংযমের বেহিসাবি অভিব্যক্তি, আর প্রকৃতির কবিতায় মুখ্যত আত্ম-আবিষ্কার-প্রবণ কবিতারাশি। ক্রোধ, বিপ্লব-বিদ্রোহ, বর্তমানময় বাস্তবতা এবং অন্যায্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম—বাংলা কবিতায় ইতিপূর্বে প্রায় অনুপস্থিত এসব উপাদানকে কাব্যভাষার অধীন করতে পারাই নজরুলের কবিভাষার সর্বোত্তম অর্জন। এর সাথে প্রধানত প্রেম-প্রকৃতির কবিতায় যুক্ত হয়েছে বৈষ্ণব কবিতার আবহ, লোককবিতার উচ্চারণভঙ্গি, নারীসুলভ কথ্যভঙ্গি এবং সাধারণ বাতচিতের বিচিত্র উপাদান। আরো দুটো উপাদান নজরুলকে দারুণভাবে আবিষ্ট করে রেখেছিল বলেই মনে হয়। একটা হল, ধ্বন্যাত্মক শব্দের নিপুণ সংস্থান, আর অন্যটা ছন্দ-মিলের অটুট সমঝোতায় শব্দ-সমাবেশ। এগুলোই, আমাদের বিবেচনায়, নজরুলের কবিভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সংকলনের কবিতা নির্বাচনে এগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ ছিল। ভাবগত প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অনুবাদকর্মকে। "
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।