ইখওয়ানুল মুসলিমিন বিশ ও একুশ শতকের ইসলামের পুনর্জাগরণের কিংবদন্তিতুল্য আন্দোলন। বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এখনও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবক আন্দোলন হিসেবে ইখওয়ান দৃশ্যপটে হাজির। প্রায় শত বছরের এই দীর্ঘ অভিযাত্রায় ইখওয়ানের অবদানকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু ইখওয়ানের সবচেয়ে বড়ো অবদান কী? ইখওয়ানের আদর্শ ও আন্দোলনের শীর্ষ ভাষ্যকার উসতায ইউসুফ আল কারযাভীর দৃষ্টিতে ইখওয়ানের সবচেয়ে বড়ো অবদান হলো— এমন এক নবপ্রজন্ম গড়ে তোলা, যারা ইসলামকে যথার্থরূপে অনুধাবন করে, ইসলামের প্রতি গভীর বিশ্বাস পোষণ করে, যারা ইসলামের কালিমাকে সমুন্নত করতে প্রাণপাত প্রচেষ্টা চালায়, যারা মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করে। এই নবপ্রজন্মই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সাথে ছড়িয়ে দিয়েছে ইসলামের পুনর্জাগরণের সবুজ স্বপ্ন। উসতায কারযাভী মনে করেন, এই নবপ্রজন্ম গড়ার সফলতার মূল উপাদান হচ্ছে ব্যাপকতর, ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তবানুগ অনিন্দ্য সুন্দর তারবিয়াত পদ্ধতি। এই বইয়ে উসতায কারযাভী ইখওয়ানুল মুসলিমিনের তালিম-তারবিয়াত পদ্ধতিকে উপস্থাপন করেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন এই পদ্ধতির ইলমি ভিত্তি। এই তালিম-তারবিয়াত কেমন মানুষ গড়ে তুলেছে এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছে তাও তিনি তুলে ধরেছেন। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের তারবিয়াত পদ্ধতি সম্পর্কে জানাটা আমাদের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে উপকারী। এর মাধ্যমে আমরা ইসলামি আন্দোলনের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতে পারি। নিতে পারি তাদের শিক্ষনীয় ঘটনাবলি থেকে প্রেরণার উপকরণ। আর ভৌগোলিকভাবে এত দূরবর্তী অবস্থানের পরও তাদের সাথে আমাদের মিলগুলো আমাদের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয় ভ্রাতৃত্বের উত্তাপ।
শায়খ প্রফেসর ড. ইউসুফ আবদুল্লাহ আল কারযাভি (১৯২৬-) মিশরীয় বংশোদ্ভূত একজন প্রভাবশালী আধুনিক ইসলামি তাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞ। তিনি মুসলিম ধর্মতত্ত্বিকদের অভিজাত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্সে (International Union of Muslim scholars)-এর সাবেক চেয়ারম্যান। জন্ম ১৯২৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। মিসরের উত্তর নীলনদের তীরবর্তী সাফাত তোরাব গ্রামে। দুই বছর বয়সে বাবা ইন্তিকাল করলে চাচা তার লালন-পালন করেন। দশ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন আল-আজহার কারিকুলামে। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Institute of Imams’ এর পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। কিছুদিন তিনি আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ‘Board of Religious Affairs’ এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরীয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডীন নিযুক্ত হন। ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন এবং একই বছর তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র’। ১৯৯০-৯১ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের Scientific Council এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার ফিরে আসেন। তিনি জর্ডানের রয়্যাল অ্যাকাডেমি ফর ইসলামিক কালচারাল অ্যান্ড রিচার্জ (Royal academy for Islamic culture and research), ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (OIC), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি এবং ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার, অক্সফোর্ড এর সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৪১১ হিজরিতে ইসলামী অর্থনীতিতে অবদান রাখায় ব্যাংক ফয়সল পুরষ্কার লাভ করেন। ইসলামি শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৪১৩ হিজরিতে মুসলিম বিশ্বের নোবেল খ্যাত কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন । ১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে ‘হাসান বাকলি’ পুরষ্কারে ভূষিত করে।