‘কবি নজরুল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটি অনেকটা দুঃখবোধ এবং ক্ষোভের কারণে লেখা। আমার বয়স এখন ৮৫ বছর। খুব ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা পড়েছি, অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছি। এসব অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের মানুষকেই দেখেছি। ব্রিটিশ আমলে নজরুলের সংগীতানুষ্ঠানে জনসমাগম হতো খুব বেশি। শিক্ষিত মানুষই শুধু নয়, যারা খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের চোখের জলের হিসেব বিত্তবানদের দৃষ্টিতে আসেনা, তাদের কাছে নজরুল ছিলেন প্রেরণার উৎস। নজরুলের গান শুনে চিত্তরঞ্জন দাশ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তেন। নেতাজী সুভাষ বসু উদ্বেলিত হয়ে উঠতেন আবেগের কারণে। বলতেন, ‘নজরুলের কবিতা ও গান আমরা কারাগারে গাইব এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও গাইব।’ ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা শহীদ হয়েছেন ফাঁসি কিংবা বন্দুকের গুলিতে; তাঁদের কণ্ঠে নজরুলের গানই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে উঠত। ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ নামে ‘দুর্গমগিরি কান্তারমরু’ গানটিকে নেতাজী সারা ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবেই গণ্য করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে নজরুলের মতো কোনো কবি এত বেশি মাত্রায় দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য জেল খাটেননি। তাঁর ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ ছিল একটি মহৎ রাজনৈতিক মহাকাব্য। ইংরেজ বিচারক যিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন, নজরুলের বক্তব্য শুনে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। রাজদ্রোহী অপরাধে নজরুলকে ফাঁসি দেবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নজরুল ছিলেন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক। মৃত্যুর ভয়ে ভীত ছিলেন না তিনি। শুধু কবি হিসেবেই নয়, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘যুগবাণী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি ব্রিটিশ সরকারকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও তারা ‘পার’ পায়নি। ‘বিষের বাঁশি’সহ অনেক কাব্যগ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। তাতে নজরুল অজেয় হয়ে উঠেছিলেন। গোপনে তাঁর গ্রন্থ বিক্রি হয়েছে হাজার হাজার মানুষের কাছে। নজরুলকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে ব্রিটিশকেই এ দেশে নিষিদ্ধ হতে হয়েছে। তাঁর ‘যুগবাণী পত্রিকা’ এবং কাব্যগ্রন্থসমূহ বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশকেই এ দেশে তাদের কবর খুঁড়তে হয়েছে। নজরুল মুসলমান হয়ে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জয়ধ্বনি ঘোষণা করেননি; বরং সাম্প্রদায়িকতাকে নিশ্চিহ্ন করতে তিনি দুর্বার গতিতে তাঁর কবিতা ও গান রচনা করেছেন। “হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী, বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার” এই নজরুলই কবি হিসেবেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন সর্বাগ্রে। মুসলমান হয়ে তিনি ‘শ্যামাসংগীত’ লিখেছেন। “আনন্দময়ীর আগমনী” কবিতায় হিন্দুদের ‘মা কালী’কে ব্রিটিশরূপী অসুরবধে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। সেখানে মুসলমানদের তিরস্কার শুধু নয়, গালি দিতেও বাঁধেনি। তাঁর অসাম্প্রদায়িক ভাবনার কারণে নিজের ‘মা’কে ফেলে হিন্দু ‘মা’কেই তিনি মা বলে জেনেছিলেন। প্রমীলাকে বিয়ে করে আজীবন তিনি প্রমাণ দিয়েছেন তাঁর অসাম্প্রদায়িক ভাবনার। আর কত পরীক্ষা নেবে ভারতের কট্টর সাম্প্রদায়িক মানুষ? নজরুলের কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ শুধু তাঁর বুকেই ধারণ করেননি, তাঁকেও তিনি বুকে তুলে নিয়েছেন আদর-সোহাগে। রবীন্দ্রনাথের মত্যুতে নজরুল অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দনাথ তাঁর জীবনের বড় আশ্রয়স্থল ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর নজরুল দুটি অসাধারণ কবিতা লেখেন। ‘রবি হারা’ ছিল তাঁর অন্যতম কবিতা। এই কবিতা পাঠ করেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ কত আপন ছিলেন তাঁর কাছে। এর পরই হঠাৎ কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কলকাতা রেডিওতে প্রোগ্রামের সময় তাঁর অসুস্থতা ধরা পড়ে। তাঁকে রোগমুক্ত করতে কেউই এগিয়ে আসেনি। দু-একজন স্বজন চেষ্টা নিলেও দরিদ্রতার কারণে তাঁর চিকিৎসা হলো না। এতবড় একজন কবি নির্বাক হয়ে ঘরেই আবদ্ধ হয়ে রইলেন। ভারতে তাঁর যথাযথ চিকিৎসা হয়নি। তাঁর এই হঠাৎ ‘নির্বাক’ হওয়ার কারণও উদ্ধার করা যায়নি। এখানেও বুঝি নজরুল সাম্প্রদায়িকতার ‘শিকার’ হয়ে থাকলেন। দুঃখ লাগে, ক্ষোভে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি, যখন শুনি সব্যসাচী লেখক শরৎচন্দ্র এ দেশের মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার রোষানলে পোড়াতে চেয়েছিলেন। ‘শ্রীকান্ত’ গল্পে তিনি এ দেশের মানুষকে মুসলমান এবং হিন্দুদের বাঙালি হিসেবে বিভক্ত করেছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, ‘মহেশ’ গল্পের লেখক কী করে এতটা নির্মম এবং নিষ্ঠুর হতে পারলেন! সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের একটি লেখা অন্যত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, আমি লেখাটি এ গ্রন্থে সংকলিত করেছি এ কারণে যে, এ দেশের হিন্দু-মুসলমান সবাই যাঁকে মাথায় তুলে রাখেন ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ হিসেবে, তারা জানুক তাঁর সাম্প্রদায়িকতার কথা। কেমন করে তিনি এত নীচুতে নামতে পারলেন! বোধহয় শরৎচন্দ্র একা নন, তাঁর মতো হয়তো এমন অনেকেই এখনো ভারতে রয়েছেন। একসময় কমরেড গোপাল হালদারও বাংলাদেশের মুসলমানদের বাঙালি হিসেবে দেখতে চাননি। তাঁর লেখা ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’-এ তিনি বললেন, বাংলাদেশের মুসলমানেরা বাংলাদেশকে তাদের স্বদেশ ভূমি বলে জানে না। তারা দৈনিক পাঁচবার আরবের মক্কার দিকে মাথা নিচু করে তাদের স্বদেশভূমির কথা ভাবে। এ থেকে বোঝা যায় যে তিনি এ দেশের মুসলমানদের ‘বাঙ্গালী’ বলেও স্বীকার করতে চাননি। অথচ এই মুসলমানরা বহিরাগত ছিল না। তারা এ দেশের ভূমিজ সন্তান ছিল। এরাই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। এরা হিন্দু ছিল না-মুসলমান এবং জাতে বাঙালি। এরা উর্দুতে কথা বলতে চায়নি। কিন্তু পশ্চিম বাংলার মানুষ হয়ে তথাকথিত এই সাম্প্রদায়িক বাঙালিরা এখন হিন্দিতেই কথা বলেন। তারাই নজরুলকে তাঁর স্বদেশেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। যৌবনের শুরুতে নজরুলের লেখা ‘দারিদ্র্য’ কবিতাকে যে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় ইন্টারমিডিয়েট বাংলা সংকলনে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করেছিল, সেই কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়েই নজরুলের কোনো ছবি বর্তমানে কোথাও ঠাঁই পায়নি। এ দুর্ভাগ্য তো নজরুলের নয়, এদুর্ভাগ্য গোটা বাঙালির। সম্প্রতি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম একটি সেশনে সভাপতিত্বও করেছিলাম। মঞ্চের দেয়ালে টাঙানো ব্যানারে উভয় বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের ছবি থাকলেও নজরুলের কোনো ছবি সেখানে স্থান পায়নি। অত্র গ্রন্থের লেখক প্রতিবাদ করায় আয়োজকদের ‘কেউ’ ‘কেউ’ তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দিয়েছেন। ইংরেজদের কাছে নজরুল ছিলেন ‘ভয়াল’ দুর্বিনীত। তাঁকে ব্রিটিশ ভয় করেছে। কিন্তু মনে মনে শ্রদ্ধাও করেছেন অনেকজন। একজন বিচারক তো মন্ত্রমুগ্ধের মতো নজরুলের বাংলায় লেখা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ বক্তব্য অধীর আগ্রহে শুনেছেন। মনে মনে লজ্জিত হয়েছেন তিনি। ভারতের পশ্চিম বাংলায় নিজের জন্মভূমিতে হিন্দুদের কাছে কি নজরুল এমনিভাবে অস্পৃশ্য এবং যবন হয়ে থাকলেন? আগামী দিনের তরুণদের সম্মুখে আমাদের কোন রূপ ধরা পড়বে। কী অপরাধে নজরুলকে এমনভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে তুলল ভারত। কেন এখনো ভারত ও পশ্চিম বাংলার মানুষ নিশ্চুপ রয়েছে? কার ভয়ে ভীত তারা? দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষ বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং তাঁদের অনুসারীবৃন্দ যাঁরা নজরুলকে সে সময় ‘কাজীদা’ হিসেবে মায়ার বাঁধনে রেখেছিলেন, তাঁরা হয়তো নজরুলের এমন অবস্থা দেখে বুক চাপড়ে ‘উন্মাদ’ হয়ে যেতেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কামানের গোলা হয়ে ব্রিটিশকে তাড়িয়েছে ভারতবর্ষ থেকে, আর সেই নজরুলকেই সাম্প্রদায়িক হিসেবে গণ্য করল ভারত? একি কুৎসিত এবং হীন চক্রন্তে গড়ে উঠল ভারত এবং পশ্চিম বাংলায়। সুকান্ত বেঁচে থাকলে কী লিখতেন তিনি! হয়তো বলতেন: অবাক বাংলা অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি বাংলা এক ‘সাম্প্রদায়িকতার’ ভূমি। নজরুলকে নির্বাসিত হতে হলেন তাঁরই স্বদেশভূমি, পশ্চিম বাংলার চুরুলিয়া গ্রাম থেকেও। এ লজ্জা বাঙালি মুছবে কেমন করে? ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ কৌশলে দেশভাগ করতে চাইল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। হিন্দু মুসলমান মিলিত হলো দেশভাগকে রুখতে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল এগিয়ে এলেন। গুটি কতক জমিদার মুসলমান এবং নবাব তাঁদের স্বার্থের জন্য তাঁরা হাত মেলালেন ব্রিটিশদের সাথে। তাঁরা মুসলিম লীগ গঠন করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠায় ‘বন্দে মাতরম’-এর ডাক দিলেন। প্রতিবাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘বাংলাদেশ শুধু হিন্দুর নয়Ñ মুসলমানেরও। এমন ধ্বনি মুসলমানদের অসন্তুষ্ট করবে।’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন লর্ড কার্জন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সময় তিনি অসন্তষ্ট হয়েছিলেন। জর্জ বার্নাড শ-এর স্ত্রীর কাছে লেখা একটা চিঠিতে তিনি সরাসরি তা বললেনও। বঙ্গভঙ্গের কারণে নজরুল প্রতিবাদেমুখর হলেন। তিনি কঠিন ব্যঙ্গ করে বললেন: জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া ॥ হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি ভাবলি এতেই জাতির জান তাই তো বেকুব, করলি তোরা একজাতিকে একশ’ খান এখন দেখিস ভারত-জোড়া পক্ষে আছিস বাসি মড়া, মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত শেয়ালের হুক্কা হুয়া ॥ এসময় হিন্দু মুসলিম মিলনকে নিয়ে নজরুল অসাধারণ কবিতা এবং গান লিখলেন। সে গান এবং কবিতায় দুই বাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করল। ১৯১১ সালে ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ প্রতিরোধ হলো। ইংরেজ সরকার ক্ষুব্ধ হলো। আবার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল তারা। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু এবং নজরুল বাকশক্তিহীন। লেখার ক্ষমতাও গেল হারিয়ে। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দিল ইংরেজ। দেশ ভাগ হলো। হিন্দুমুসলিম মিলনের কথা বলার কেউ থাকল না। নজরুল অপলক নয়নে কেবল তাকিয়ে থাকলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতাজী সুভাষ বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ বসুর সন্তান ডা. শিশির বসু পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন বর্ডারে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যদের চিকিৎসার জন্য ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে তুলেছিলেন। সে সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর ভারত কেবল হিন্দুদেরই আশ্রয় দেয়নি, লাখ লাখ মুসলমানকেও আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল যত্নসহকারে। বাংলাদেশ তা ভোলেনি। বঙ্গবন্ধু ৯ মাস জেলে মৃত্যুকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় শেষে দেশে ফিরলেন। এসে শুনলেন নজরুলের দুরবস্থার কথা। নেতাজী সুভাষ বসুর মতোই নজরুল ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। তবে মুসলমান হিসেবে নয়, সকল অন্যায়, মিথ্যা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী একজন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে ফিরে এসে তিনি কবির দুর্ভোগের কথা শুনলেন। এখানে উল্লেখ্য, ভারত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা কবি নজরুল যে শুধু ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তা শুধু নয়, তিনি বাংলার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র হিসেবে। এ নিয়ে তাঁর কবিতাও আছে। ‘জয় বাঙ্গলা’ শব্দটিও সে কবিতার অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গবন্ধু নজরুলকে তাই জাতীয় কবি এবং রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। আমাদের দুঃখ দেশভাগের পর হিন্দুস্তান পাকিস্তান নামের দুই রাষ্ট্র নজরুলের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। তখনকার কিছু পূর্ব পাকিস্তানি সাহিত্যিক-কবিরা নজরুলের গান ও কবিতাকে ‘মুসলমানী’ বানাবার চেষ্টা করে ছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁ এবং আরও কিছু মুসলমান কবি নজরুলকে কাফের বলতেও ছাড়েননি। দেশভাগের সময় নজরুল বাকহীন হয়ে তাঁর প্রতি সাম্প্রদায়িক মানুষদের প্রতিহিংসাই লক্ষ করেছিলেন। ১৯৬২ সালে নজরুলপত্নী প্রমীলা মৃত্যুবরণ করলেন। নজরুলকে দেখাশোনার আর কেউ তেমন ছিল না। প্রমীলার ‘মা’ নজরুলকে দেখেছেন। তাঁর কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে গেলে নিজেই সেসব ধুয়ে দিয়েছেন। হিন্দু হয়েও নজরুলকে স্নেহ-মায়া দিয়ে বুকের ভেতর নিয়েছেন। শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর হঠাৎ নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ৩২ বছর তিনি বেঁচেছিলেন। নজরুলের অসহায় অবস্থা দেখে বঙ্গবন্ধু দারুণ কষ্ট পেলেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। একদিকে বন্যা, অপরদিকে যুদ্ধের পর ফসলবিহীন মাঠ। দুর্ভিক্ষের হাতছানি। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের মানুষকে বাঁচাবার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন সর্বাগ্রে। পৃথিবীর কাছে তিনি হাত পেতেছেন সাহায্যের জন্য। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এর মধ্যেও বঙ্গবন্ধু ভোলেননি নজরুলকে। তিনি লক্ষ করলেন ভারত হিন্দুস্তান হয়ে যাওয়ায় সেখানকার মুসলমানদের প্রতি একশ্রেণির মানুষ বিদ্ধেষভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। ‘নজরুল’কে তাঁর যথাযথ স্থান তারা দেয়নি। নজরুল বাকহীন। সন্তানেরা দিশাহারা। এমনি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ২৪ মে ১৯৭২ নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার প্রস্তাবে ভারত সরকার থেকে কোনো আপত্তি এলো না। সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরা ভাবল: ‘যাক, বাঁচা গেল’। অন্নদাশংকরের কবিতা ‘মিথ্যা’ হলো। কিন্তু কত ক্ষুদ্র হয়ে গেলাম আমরা! বাঙালি বলে আমাদের পরিচয় দিতে আজ লজ্জা আসে। এই বাঙালিদের মধ্যেই কিছুজনের ষড়যন্ত্রে নেতাজী সুভাষকে জেলে যেতে হয়েছে। কংগ্রেসের সভাপতিও থাকা সম্ভব হয়নি। তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছে দেশের মুক্তির জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে বাংলাদেশে নজরুল এবং তাঁর পরিবারের অনেককেই বঙ্গবন্ধু একটু শান্তির পরিবেশ দিতে পেরেছিলেন নজরুলকে, রাষ্টীয় মর্যাদা দিয়ে। ভারতের ওপরেই এই দায়িত্ব বর্তে ছিল যখন দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন ভারতে নজরুল মর্যাদাহীন একজন নির্বাক কবি হয়ে মৃত্যুর জন্য দিন গুনছিলেন। সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব। কিন্তু নজরুলকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ বঙ্গবন্ধু পেলেন না। মীরজাফরের হাতে যখন সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটল এবং তারপর বিশ^াসঘাতকদের হাতেই তাঁর মৃত্যু হলো। বঙ্গবন্ধুর বেলায় প্রায় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। বঙ্গবন্ধুর একান্ত প্রিয়জন, খোন্দকার মোশতাক যার নাম, তার সহযোগিতায় তাঁকে প্রাণ দিতে হলো পরিবারসহ একদল বিশ^াসঘাতক সেনাসদস্যের হাতে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এক বছর পর নজরুলের মৃত্যু হলো সেই আগস্টমাসে, কেবল তারিখ এবং সালে এক বছরের পার্থক্য ২৯ আগস্ট ১৯৭৬। একটিই কেবল আমাদের সান্ত্বনা। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা শুনেছিলেন। আল্লাহর একজন প্রিয়বান্দা হয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কবর দেওয়া হলো তাঁরই ইচ্ছানুযায়ীÑ যা তিনি লিখেছিলেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমায় করব দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই॥’