মরণের ডঙ্কা বাজে উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে চীনের জনগণের ওপর | জাপানিদের আক্রমণ। দুই ভারতীয় বেকার তরুণ বিমল ও সুরেশ্বর কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুর গিয়ে জাপানি হামলায় আহত চীনের জনগণের সেবায় নিয়ােজিত হওয়ার আমন্ত্রণ লাভ করে। জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা এই আমন্ত্রণে সাড়া দেয় মূলত তারুণ্যের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের উৎসাহে ও নতুন দেশ ভ্রমণের আগ্রহে। কিন্তু রণক্ষেত্রে গিয়ে যে-পরিস্থিতির শিকার তারা হয় তা যেমন ভয়াবহ তেমনি কল্পনাতীত। রণক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যু তাদের তাড়া করে। | এ উপন্যাসে বিমল ও এ্যালিসের মধ্যে যে মানবীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার অপাপবিদ্ধ নিষ্কলুষ বৈশিষ্ট্যটিও তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন তরুণী এ্যালিসের যুদ্ধাক্রান্ত চীনা জনগণের সেবায় নিয়ােজিত হওয়া কিংবা নিজ সম্পদ দুস্থদের কল্যাণে ব্যয় করার আগ্রহের মধ্যেও রয়েছে তীব্র মানবীয় প্রেরণা। উপন্যাসের পরিসমাপ্তি-অংশের ব্যঞ্জনাও লক্ষণীয়। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যটির পটভূমিতে রয়েছে একটি মন্দির। যুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্যে এক তরুণ তার অনেকদিনের বাগদত্তা মেয়েটিকে বিয়ে করার পর নববধূসহ আসে এই মন্দিরে। দুজনেই জানে যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছেলেটির ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং চীনের সম্ভান্ত সমাজে বিধবা বিয়ের প্রচলনও নেই। এসব সত্ত্বেও দুজনেরই মুখে হাসি-আনন্দের প্রশান্তি। মন্দির চত্বরে এদের দুজনকে ঘিরে প্রফেসর লী, বিমল-এ্যালিসসুরেশ্বর-মিনির আশীর্বাদ ও আনন্দের পুষ্পবৃষ্টির মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হয়। আমরা লেখকের কাছ থেকে এই বার্তাই পাই যে, ব্যক্তির আনন্দ-বেদনা-স্বার্থ কোনােভাবেই মুখ্য হতে পারে না, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশ, মানুষের কল্যাণ। সর্বমানবের মঙ্গলের লক্ষ্যেই শেষ দৃশ্যে এই ব্যক্তিবর্গ নিজেদের উৎসর্গ করে। এমনকি বিমল-এ্যালিস-সুরেশ্বর-মিনি এরাও দেশের সীমা ডিঙিয়ে ধর্ম-বর্ণ-জাতির ভেদ ভুলে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিকতাবাদী। — সৈয়দ আজিজুল হক
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।