রিজিয়া রহমানের সংকলনভুক্ত এই ছয়টি উপন্যাসে, বিন্যাসে, কাহিনীতে বাঙালি জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল, বালুচ ও কালাতের স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবিরোধী জনযুদ্ধ, বাংলাদেশের নিরন্ন নারীসমাজের রুখে দাঁড়ানোর ইতিকথা, ব্রিটনীদের দাসত্ব ও দাসত্বমুক্তির বিজয়গাথা এবং বঙ্গ লুণ্ঠনকারী বীরদপীর উত্তরাধিকারের মর্মদত্ত পরিণতি ইত্যাদি বিম্বিত। ‘বং থেকে বাংলা (১৯৭৮)’-য় লেখিকা বাঙালির জাতিসত্তা, তাঁদের সময় ও সংগ্রামকে সচেতন ঐতিহ্যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। ‘একাল চিরকাল (১৯৮৪)’ মূলত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সাঁওতাল সমাজের শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বমোচনের অস্তিত্ব, অধিকার প্রতিষ্ঠার ও জাতিসত্তার যুথবদ্ধ সংগ্রামের ইতিহাস। অন্যদিকে, ‘রক্তের অক্ষর (১৯৭৮)’-এ লেখিকা প্রকাশ করেছেন বাংলার নগরজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং পাশবিক হিংস্রতায় দ্বিধাদীন এক ধূসর জগতের কথকতা। রিজিয়া রহমানের ‘শিলায় শিলায় আগুন’-এর মূল প্রতিপাদ্য পাকিস্তানের সামরিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বালুচ ও কালাতের মুক্তিকামী মানুষের বিদ্রোেহ ও রক্তাক্ত যুদ্ধের বৃত্তান্ত। এই উপন্যাস শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনাকে সঞ্চারিত করে। উপনিবেশবাদীর নিষ্পেষণে দাসত্বে পর্যুদস্ত ব্রিটনীদের অত্যাচারের আর্তনাদ শুনেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু বঙ্কিমের অক্ষমতার মর্মবেদনাকে, অলিখিত এবং অসমাপ্ত আখ্যানকে নির্ভীকতায় লিপিবদ্ধ করেছেন রিজিয়া রহমান তাঁর ‘অলিখিত উপাখ্যান’-এ। ‘সোনার বাংলা’ লুণ্ঠনকারী তথাকথিত হার্মাদ জলদস্যু বীর গঞ্জালেসের উত্তরপুরুষের অসহায় পরিণতির এক ঐতিহাসিক বাতাবরণ লেখিকার ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাস। ইতিহাস, সমাজ, মানুষ এবং তাঁদের টিকে থাকার, প্রতিষ্ঠার ও জাগরণের সংগ্রামের দলিল রিজিয়া রহমানের সাহসী কলমে চিত্রিত হয়েছে এই ছয়টি উপন্যাসে।
রিজিয়া রহমান বাংলাদেশের প্রথম সারির ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একজন। জনু ২৮ ডিসেম্বর। ১৯৩৯ সালে, কোলকাতার ভবানীপুরে। বাবার নাম মরহুম ডা. আবুল খায়ের মােহাম্মদ সিদ্দিক। মা-মরহুমা মরিয়ম বেগম। আদি পৈতৃক নিবাস পশ্চিমবঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর কয়েক বছর অধ্যাপনায়। নিয়ােজিত ছিলেন, একটি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন রিসার্চ অফিসার হিসেদ্ধে কাজ করেন। রিজিয়া রহমানের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা চলিশের অধিক। শতাধিক ছােটগল্প লিখেছেন তিনি। লেখালেখির অঙ্গনে প্রায় সবগুলাে শাখাতেই তার কলমের স্বচ্ছন্দ বিচরণ । প্রবন্ধ, সমালােচনা, কবিতা, রম্যরচনা ও শিশুতােষ লেখা ছাড়াও দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। দীর্ঘ কয়েক বছর সাহিত্য পত্রিকা ত্রিভুজ-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার লেখা অনূদিত হয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি দেশে এবং বিদেশে প্রশংসিত হয়েছেন, পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, যশাের সাহিত্য ? পরিষদ পুরস্কার, স্পষ্টবাদী পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ স্বর্ণপদক, কমর মুশতরী স্বর্ণপদক, কবি জসিমউদ্দীন পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার, সা'দত আলী আকন্দ সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার উল্লেখযােগ্য।