আমার ক্ষুদে পাঠকেরা, তোমাদেরকে আমি নেহার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। মিষ্টি মেয়ে নেহার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো ব্রাসেলস বিমানবন্দরে। আমরা বাংলাদেশ বিমানের একই ফ্লাইটে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলাম। আমি বিমানে উঠেছি ঢাকা থেকে, নেহা উঠেছে দিল্লি থেকে। ওর মা আর ছোট একটি ভাই ছিলো সঙ্গে। নেহার বয়স কত হবে? দশ-এগারো হতে পারে। পাতলা, ছিপছিপে। গোছা চুল বেণি করা। পরনে লেগিনস আর টি-শার্ট। ওর টানা বড় চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক নেই। চোখ দুটো বেশ শান্ত আর সিগ্ধ। বিমানবন্দরে আমরা যেখানে বসেছিলাম নেহা ভাইটির সঙ্গে তার আশপাশে দৌড়াদৌড়ি করছিলো। কেন জানি ওদের এই ছোটাছুটি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগছিলো। আমি ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বুঝি আর হয় না। শিশুরাই বুঝি স্বর্গ, এমন একটি ভাবনা আমাকে উদ্বেলিত করে। শিশুরাই বুঝি ধর্ম, এমন ভাবনায়ও আমি আলোড়িত হই। ভাবি শিশুদের জন্য প্রার্থনা করলেই শুধু ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করা যায়। আমি ঈশ্বর-প্রদত্ত দুই চোখ মেলে অপরূপ দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে বলি, ঈশ্বর ওদের রক্ষা করো। ওদের দিকে যেন কখনো বন্ধুকের গুলি ছুটে না আসে। ওরা যেন বিস্ফোরিত বোমার টুকরায় আহত না হয়। কোনো পাচারকারী যেন ওদের অন্য দেশে পাচার না করে। ওরা যেন পৃথিবীর সবটুকু ভালোর অধিকারী হয়। আমাদের যা কিছু সর্বোত্তম তা যেন শিশুরাই পায়। মনে মনে ইশ্বরের কাছে এই আবেদন করে আমি সুস্থির হয়ে বসি। দেখতে পাই ওরা দু’ভাইবোন অনেক দূরে চলে গেছে।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।