"ওগুস্তেঁ ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ" বইটির শেষের ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ ১৭৮৫ সালে ফরাসি চন্দননগরে কর্মরত তরুণ ভাষাবিদ ওগুস্তে ওসা প্রণয়ন করেছিলেন বাংলা-ফরাসি শব্দের কোষ। এটি কেবল বাংলা-ফরাসি শব্দের সর্বপ্রথম সংগ্রহ ছিল না, বাংলা ও কোনাে ইউরােপীয় ভাষার দ্বিভাষিক শব্দকোষ প্রণয়নের এ-ছিল অন্যতম আদি প্রয়াস। প্যারিসের বিবলিওথেক নাসিওনালে গচ্ছিত এই পাণ্ডুলিপি এতােকাল পর আলাের মুখ দেখলাে ফরাসি ভারততত্ত্ববিদ ফ্ৰাস ভট্টাচার্য এবং বাঙালি বিদ্বজ্জন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যুগ্ম প্রয়াসে। দুই কৃতবিদ্য গবেষক কেবল পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করেননি, মুখবন্ধে ওগুস্তে ওসা ও তার কাল এবং শব্দকোষের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন বিশদভাবে। তার ফলে নিছক ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনা নয়, ভাষাসংস্কৃতি ও সামাজিক ইতিহাসের অনেক অজানা দিক উন্মােচিত হয়েছে কৃশকায় এই গ্রন্থে। আগ্রহী গবেষকদের জন্য স্বর্ণখনির দ্বার উন্মুক্ত করবে আদি এই শব্দকোষ, ভাষাগত আগ্রহ মেটাবার পাশাপাশি সমাজগবেষক ও ইতিহাসবিদদের জন্যও চিন্তার খােরাক জোগাবে। এমন এক বিরল গ্রন্থ বের করার সুযােগ পেয়ে সাহিত্য প্রকাশ সম্পাদকদ্বয়ের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এবং গর্ব অনুভব করছে দুষ্প্রাপ্য ও প্রায়-বিস্মৃত পাণ্ডুলিপির এই পাঠ পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে।
আনিসুজ্জামান একাধারে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ভাষা সংগ্রামী, সংবিধানের অনুবাদক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক। এককথায় তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এই গুণীজন ১৯৩৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুল থেকে। কৈশোরে পরিবারসমেত বাংলাদেশে চলে আসলে খুলনা শহরের এক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন আনিসুজ্জামান। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতক জীবনে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মুনীর চৌধুরীর মতো কিংবদন্তি শিক্ষকদের, যাদের সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি বেশ কিছু বৃত্তি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন এবং 'কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো' হিসেবে লন্ডন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি শিল্প ও সাহিত্যকলার বিভিন্ন শাখায় জড়িত আছেন। আনিসুজ্জামান এর বই সমগ্রতে তার প্রখর চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। আনিসুজ্জামানের বইগুলো বেশিরভাগই গবেষণা এবং প্রবন্ধধর্মী। আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ এবং গবেষণা গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘আমার একাত্তর’, ’সোশ্যাল এস্পেক্টস অব এন্ডোজেনাস ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি’ ইত্যাদি। আনিসুজ্জামান এর বই সমূহ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'সাহিত্যে ও সমাজে', 'কালচার এন্ড থট', 'নারীর কথা', 'আইন-শব্দকোষ' ইত্যাদি। তিনি অসংখ্য পদক-পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন। সেসবের মধ্যে ১৯৭০ সালে প্রবন্ধ-গবেষণার জন্য ‘বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ১৯৮৫ সালে শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০০৫ সালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডি.লিট’ ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১৪ সালে তিনি ভারত সরকার প্রদত্ত 'পদ্মভূষণ' পদক লাভ করেন।