বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের বিস্ময়পূর্ণ জগৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনিবার্য নাম। বিচিত্র বিষয় ও নানান অনুষঙ্গ তাঁর গল্পের ভুবনকে ঋদ্ধ করেছে। বিভূতিভূষণের ভয় ও ভৌতিক গল্পগুলো বরাবরই সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সেই দাবিকে সামনে রেখেই এক মলাটে হাজির হলো―বিভূতিভূষণের ভয় ও ভৌতিক গল্পসমগ্র। বিভূতির ভয় ও ভৌতিক গল্পসমূহ নিছক শিশু-কিশোর মহলের গল্প নয়, বরং তারও অধিক। কোনো নির্দিষ্ট বয়সের সীমানা নির্ধারণ করে বিভূতিভূষণের এ ধারার গল্পগুলো রচিত হয়নি। বরং এক সর্বাঙ্গীণ শাশ্বত চাহিদা তৈরি হয় বিভূতির ভয়-রসের গল্পকে ঘিরে। আমরা দেখি─ভয় ও ভৌতিক আবহ ছাড়িয়ে বিভূতির গল্প তৈরি করে বিশুদ্ধ নান্দনিক সৌকর্যের। মিথ ও ইতিহাসের চেনা পথ ধরে বিভূতির এ ধারার গল্পে ঔপনিবেশিক সময়ের চালচিত্র যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি হাজার বছরের লোকায়ত সমাজের সংস্কার, প্রথা, বিশ্বাসের জলছাপ যেন বাঙময় হয়ে ধরা দেয়। ফলে বাঙালির শাশ্বত লোকবিশ্বাস, ভারতবর্ষের উপনিবেশ-তাড়িত সময় এবং লেখকের স্বকীয় বীক্ষণ এক মহার্ঘ বস্তু হিসেবে বিভূতির এ ধারার গল্পে আলো ছড়ায়। বিভূতিভূষণের এ ধারার গল্পে যেন অনাবিষ্কৃত প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় নতুনতর আনন্দ ও প্রাপ্তি নিয়ে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।