উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকে যেসব মুসলমান লেখক মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য সাধনা করেছেন, তাদের অনেকেই স্বতন্ত্র একক আলোচনা অথবা আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় পরিচিতি পেয়েছেন। এঁরাই আমাদের মাতৃভাষা চর্চায় অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছেন এবং এরই মাধ্যমে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে মুসলিম সমাজকে অজ্ঞানতা এবং কুসংস্কারমুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। লক্ষণীয়, প্রতিবেশী হিন্দু লেখকদের পাশাপাশি এদের অবস্থান একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। মাতৃভাষায় মৌলিক সাহিত্য চর্চা যেমন সমৃদ্ধতর হয়ে উঠছিল, তেমনি অনুবাদ সাহিত্য আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে প্রসারিত করছিল। শিক্ষিত মুসলিম সাহিত্যসেবী ও সাধকবৃন্দ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, মাতৃভাষা চর্চার যেমন বিকল্প নেই, তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক- ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষা চর্চা অপরিহার্য। এদেশীয় আপামর সাধারণ মুসলিম সমাজে যে নানা কুসংস্কার জমাট বেঁধে উঠেছে, মাতৃভাষাই পারে এ অচলায়তন ভাঙতে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা দেরিতে হলেও মুসলিম সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। জ্ঞান- রাজ্যে অনুবাদ সাহিত্য এমন এক মাধ্যম, যা মানুষের বিচিত্র বিষয় সম্পর্কিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও ধারণার নিরসন ঘটায় এবং বহির্বিশ্বের সাথে পরিচিতির অর্গল খুলে দেয়।
মৌলভী আলাউদ্দিন আহমদ (১৮৬৪-১৯৫৫) কৃতবিদ্য মানুষ, জীবনে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, বিশেষভাবে জায়মান মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন সমাজ ও স্বদেশের বিভিন্ন পরিবর্তনময়তা। পাবনা জেলার শাহজাদপুরে তাঁর জন্ম, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাশাপাশি এন্ট্রান্স অবধি পড়েছিলেন, আরবি, ফার্সি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অর্জন করেছিলেন ব্যুৎপত্তি এবং লেখক-জীবনে সব ক’টি ভাষায় চর্চার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বিশেষভাবে মনােনিবেশ করেছিলেন অনুবাদ-কর্মে এবং বিদ্বৎসমাজের সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পরিণত জীবনে তিনি যে আত্মকথা রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন সেটা তাই আমাদের সামাজিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। নদী ভাঙনে বিপর্যস্ত পরিবারে রক্ষিত এই পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যেতেই বসেছিল, ভাগ্যক্রমে যদি তার সন্ধান না মিলতাে। বহুমাত্রিক এই আত্মস্মৃতি আগ্রহীজনদের কাছে হীরকখণ্ড রূপেই বিবেচিত হবে, এর দ্যুতিময় বিভা সমাজ-ইতিহাসের অনেক অজানা দিক আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করে। এমন এক দুর্লভ ও প্রয়ােজনীয় গ্রন্থ পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়।