ভূমিকা : পাঠকের কাছে লেখক শারমিন আঞ্জুমের পরিচয় দেওয়ার কিছুই নেই। বরং আমি আমার পরিচয় দিই। আমি ফৌজিয়া খান তামান্না, সম্পাদক নই, তবে সম্পাদনার মতো সুক্ষ্ম ও জটিল কাজটি মন দিয়ে শিখছি। সেই সুবাদে জনপ্রিয় লেখক শারমিন আঞ্জুমের মৌতাত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি নিয়েছিলাম। শারমিন আঞ্জুমের লেখা পাঠক ও লেখক মহলে দারুণ সমাদৃত। তারপরও বেশ কয়েকজন সাহিত্য রসিককে বলতে শুনেছি, 'শারমিনের লেখার কাহিনি, শব্দচয়ন, সংলাপ চমৎকার। কিন্তু বাক্যগঠন ও বিরামচিহ্নজনিত একটু দুর্বলতা আছে। সেইসঙ্গে কাহিনির পরম্পরা বুঝতে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হয়। এই সামান্য অসামঞ্জস্যগুলো যদি উতরানো যায়, তাহলে শারমিনের প্রতিটি লেখাই বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকবে।' সম্মানিত লেখক ও সাহিত্য রসিকদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে শারমিন আঞ্জুমের মৌতাত উপন্যাসটিতে সামঞ্জস্য আনার গুরুদায়িত্ব আগ বাড়িয়ে নিয়ে নিলাম। কিন্তু খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে বিপত্তি বাঁধল। বিরামচিহ্নজনিত টুকটাক ঝামেলা ঠিক করলাম, প্রুফ রিডারের কয়েকটি অসঙ্গতিও ঠিক করলাম, টাইপোজনিত কয়েকটি কারেকশনও দিলাম। কিন্তু কাহিনির পরম্পরায় আমি চেষ্টা করেও হাত দিতে পারলাম না। কারণ, প্রথম দুটো অধ্যায় পড়ে চরিত্র ও ঘটনার মধ্যে ঢুকতে আমার যেটুকু সময় লেগেছে, তাকে আমি লেখার ত্রুটি বলতে পারছি না। কারণ, যে কোনও বিস্তারিত প্লটের উপন্যাসের কাহিনির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেও এই সময়টুকু লাগেই। বহু রহস্য, রোমাঞ্চ উপন্যাসে আরও সময় লাগে, এমনকি পুরো বই শেষ করেও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি, এমন অসংখ্য বিখ্যাত উপন্যাস আছে। বরং শারমিন আঞ্জুমের লেখার এই যে, একটু একটু করে নানান জায়গা ছুঁয়ে দিয়ে গল্পের ডালপালা ছড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার ধরন, এটির একটি নিজস্বতা আছে। আরও খেয়াল করলে দেখা যায়, এই ছটফটে ধরনটি লেখকের ঠিক সেই লেখাতেই থাকে যে লেখার চরিত্রদের সঙ্গে ধরনটি মিশে যায়। সমালোচক হিসেবে লেখকের জন্য আমার আন্তরিক পরামর্শ থাকবে, চরিত্র ও প্লটের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে এবং পাঠককে একাত্ম করেই তিনি তার নিজ ধারায় এভাবেই লিখে যাবেন। উপন্যাস হিসেবে 'মৌতাত' ইতোমধ্যে অনলাইন পাঠক সমাদরে গ্রহণ করেছেন। সালমান এবং অদ্বিতার গল্প সমানভাবেই উপন্যাসে গুরুত্ব পেলেও আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে, পুরো উপন্যাসটি আসলে অদ্বিতার জার্নি। সালমান সেই জার্নির সহযাত্রী মাত্র। উপন্যাসটির কাহিনির সঙ্গে অদ্বিতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তাতে পাঠক একাত্ম হয়ে চমৎকার একটি জীবনবোধের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। 'মৌতাত' নামটির মধ্যেই উপন্যাসটির নির্যাস মাখা রয়েছে। অদ্বিতা এক নেশার মৌতাতে একটি ভুল সিদ্ধান্তে জীবনের অন্যতম যাত্রা শুরু করলেও সেই জীবনেরই একপর্যায়ে এসে নেশার ঘোর অনোদিকে ঘুরে যায়, কীসের এক মৌতাতের ঘোরে যেন তখন সে জীবনের সকল অন্যায় ও ভুলের স্খলন ঘটাতে উঠে পড়ে লাগে! অন্যদিকে সালমানের মৌতাতের তল পেতে উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত পাঠককে যেতেই হবে। রুপার মৌতাতের ঘোরই কি ঠিক ছিল? মৌতাতের প্রত্যেক চরিত্রের সংলাপে রয়েছে কঠিন বৈচিত্র্য, এবং তা পুরোপুরিই চরিত্রদের বয়স, শিক্ষা, পরিবার, পরিবেশের সঙ্গে মানানসইভাবেই মিশে গেছে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পারিবারিক মূল্যবোধ, এবং রোমান্টিক ঘরানার উপন্যাসটিতে পাঠক নিমজ্জিত হবেন ভালো লাগায়, এটিই আমার প্রত্যাশা।