ভূমিকা পরশুরাম ওরফে রাজশেখর বসুর মৃত্যুর পরে ষাট বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, তাই যথানিয়মে তাঁর গ্রন্থ তাঁর গ্রন্থগুলির স্বত্বমুক্তি ঘটেছে। এই সুযোগে তাঁর নানা রচনা, বিশেষত তাঁর অসামান্য গল্পগুলিকে সমগ্রভাবে নিশ্চয় এখন অনেক প্রকাশকই প্রকাশ করবেন। নিউ লতিকা প্রকাশনীও তার যথাসাধ্য সামর্থ্য নিয়ে এই কাজে এগিয়ে এসেছে। আমরা মনে করি এই কাজ বাঙালি পাঠকের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূল, কারণ প্রতিযোগিতার মধ্য থেকে যোগ্য সংস্করণটি তিনি বেছে নিতে পারবেন। পরশুরামের স্বত্বমুক্তি এক দিক থেকে স্বস্তিরও বটে, কারণ তাঁর মতো একজন পূর্ণসিদ্ধিকামী (ইংরেজি perfectionist কথাটির অপটু বাংলা) লেখকের প্রতি তাঁর বইয়ের আগেকার প্রকাশনাগুলি যথেষ্ট সুবিচার করেনি বলে আমাদের ধারণা। অপটু আর অপরিচ্ছন্ন মুদ্রণ, প্রচুর মুদ্রণপ্রমাদ, গুণহীন কাগজ, পরিকল্পনায় কৃপণতা (পাতার চারপাশের পরিসর অতি অল্প), পরে অসমর্থ সম্পাদনা—ইত্যাদিতে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধার চেয়ে ব্যাবসায়িক লক্ষ্য বেশি ফুটে উঠেছিল বলে বইগুলি দেখতে সুশ্রী বা প্রকাশনায় উৎকর্ষের উদাহরণ হয়নি। সালতারিখের প্রতি বিপুল উদাসীনতা তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরশুরামের মতো লেখক আরও বেশি শ্রদ্ধা আর মনোযোগ দাবি করতেন বলে আমাদের বিশ্বাস। নিউ লতিকা প্রকাশনী, তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, ওই মহৎ স্রষ্টার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিয়ে এই কাজে অগ্রসর হয়েছে। তার সাফল্য-বিচারের ভার সুধী পাঠকের উপর।
ছদ্মনাম পরশুরাম। জন্ম ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ, মঙ্গলবার। বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের সন্নিকটে বামুনপাড়া গ্রামে, মামা বাড়িতে। পৈত্রিক নিবাস নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী উলা বীরনগর। বাবার নাম চন্দ্রশেখর বসু। তিনি সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রের অনুরাগী ছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত বেদান্তদর্শন, বেদান্তপ্রবেশ, সৃষ্টি, অধিকারতত্ত্ব, প্রলয়তত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থ সেকালে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বাবার সঙ্গে লেখকের বাল্যকাল কেটেছে বাংলার বাইরে। মুঙ্গের জেলার খড়্গাপুরে। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার রাজ স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭ পাটনা কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৯৭ সালে ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। ১৮৯১ সালে কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পাস করেন। ১৯০০ সালে রসায়ন শাস্ত্রে এম.এস.সি-তে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। বেঙ্গল কেমিকেল ওয়ার্কস-এ চাকরি শুরু করেন। ১৯০৩ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানে প্রভূত উন্নতি সাধন করে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্যের উপর ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। বিশেষ করে হাস্যরসাত্মক রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাংলা সাহিত্যে পরশুরাম ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ করেন এবং রম্য-রচনার মাধ্যমে পাঠকদের মন জয় করেন। হয়ে ওঠেন বাংলার হাস্যরসাত্মক রচনার শ্রেষ্ঠ লেখক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি : কজলী, গড্ডালিকা, লঘুগুরু, নীলতারা, কৃষ্ণকলি, লম্বকর্ণ, ভূশুণ্ডীর মাঠ, হনুমানের স্বপ্ন, ভারতের খনিজ, গল্পকল্প প্রভৃতি। তাঁর রচিত চলন্তিকা অভিধান বাংলা ভাষা শিক্ষার্থীদের কাছে অমূল্য সম্পদ। অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ 'একাদেমী’, ‘রবীন্দ্রপুরষ্কার' সহ বহু পুরষ্কার পান। ভারত সরকার থেকে ‘পদ্মভূষণ’লাভ করেন। ১৯৬০ সালের ২৭ এপ্রিল রাজশেখর বসুর মৃত্যু হয়।