বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠগ্রন্থ হিসাবে ‘পথের পাঁচালী’ ‘অপরাজিত’ ও ‘আরণ্যক’-এর নাম বারবার ওঠে, কিন্তু আমাদের মনে হয় তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ─‘দেবযান’। কী রচনাশৈলীতে, কী বিষয়বস্তুতে, কী মননশীলতায়, কী মনোরম ভাষাভঙ্গিমায় এটি তুলনারহিত এবং বিস্ময়করও বটে।... ‘দেবযান’ বিস্ময়কর এইজন্য যে, উপনিষদে যে ‘ব্রহ্মচক্র’-এর কথা জানা যায় বা গীতায় ‘ন হন্যতে’র যে বাণী আমরা পাঠ করি, তা উপন্যাসাকারে, কাহিনী-বৃত্ত বজায় রেখে এভাবে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যে বিশাল পটভূমিকায় পাঠকচিত্তে পৌঁছে দেওয়া যায়, আমাদের কাছে তা ধারণার অতীত। আসলে ‘দেবযান’-এর স্বর্গ-সৃষ্টিতে বিভোর হয়ে যে জগৎ বিভূতিভূষণ সৃষ্টি করে গেছেন, আসলে তা প্রেমের জগৎ। এই প্রেম হৃদয়ে সঞ্জাত না হলে ঈশ্বরের স্বরূপকেও ধারণার মধ্যে আনতে পারা যায় না। এই গ্রন্থে ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় অনেক কথা আছে, জ্ঞান ও ভক্তি, দুই পথ-রেখারই প্রসঙ্গ আছে, সাকার ও নিরাকার নিয়েও আলোচনা আছে, কিন্তু সব ছাপিয়ে যা আছে, তা লেখকেরই নিজের ঈশ্বরানুভূতির স্বরূপ।... ‘দেবযান’-এ পরলোক-বর্ণনা থাকলেও ‘দেবযান’ অন্য মাত্রার গ্রন্থ। লেখকের নিজের উপলব্ধিসঞ্জাত এক সত্যাশ্রয়ী উপন্যাস। আজ প্রতীচ্যের ভোগবাদ ও জড়বাদে জর্জরিত হয়ে মানুষ যা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার সন্ধান দিতে পারে এই ‘দেবযান’─এটি প্রাচীন ভারতবর্ষের দার্শনিক চিন্তার অনুবাহী হয়েও ভারতবর্ষের মুক্তিচিন্তার অগ্রদূত, লেখকের মননে ও চিন্তার মুকুরে প্রতিফলিত এক অভূতপূর্ব ‘দর্শন’। ─শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।