একটানা বৃষ্টি। পরপর দু-দিন। একটুও কামাই নেই বর্ষণের। কখনো-সখনো বৃষ্টির বেগ একটু কমে এলে বাদল ভাবে এই বুঝি ধরে গেল বৃষ্টি। বেরিয়ে পড়ে কাজে। কিন্তু দু-পাঁচ মিনিট কাটতে না কাটতেই আবার শুরু হয় বর্ষণ। সমস্ত নিশ্চিন্ততাকে জিভ ভেংচে ঝরঝর ধারায় বেড়েই চলে বৃষ্টি। আর এই অবিশ্রান্ত বর্ষণে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বাদলের মনে পড়ে বছর বারো আগের সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা। সেবার বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বিশ্বকর্মা পূজার আগের দিন। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ দিনটি নির্দিষ্ট থাকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আরাধনার জন্য। ছোটো-মাঝারি-বড়ো যে কোনও ধরনের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন নেচে ওঠে আনন্দে। তাছাড়া রিকশা, ভ্যান, অটো, ট্যাক্সি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনও এই দেবশিল্পীর বন্দনায়, উপাসনায় সামিল হয়। আর এই সমস্ত পূজা-পার্বণের দিনেই ডাক পড়ত বাদলের। বাদল দাসের। গ্রামের লোকে কেউ বলত বাদল বায়েন, কেউ-বা ‘ঢোকো বাদল’। হ্যাঁ, বিভিন্ন ধরনের পূজাতে ঢাক বাজাত বাদল। বাদল পেশায় ছিল কৃষিমজুর। অবসর সময়ে বা সন্ধ্যার পর ঢাক বাজানো অনুশীলন করত সে। দূর দূর গ্রাম থেকে ডাক আসত। মালকোঁচা মেরে ধুতি পরে, কোমরে গামছা জড়িয়ে নিত বাদল। গায়ে কখনও থাকত হাতাওয়ালা সাদা গেঞ্জি, কখনও বা ফতুয়ার মতো জামা। ঢাকটাকে ঝাড়াই-মোছাই করে কাঁধে তুলে নিত। ঘর থেকে বেরোবার আগে মালতী কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলত ‘দুগ্গা-দুগ্গা’। বিশ্বকর্মা পূজার দিন থেকেই ফি বছর শুরু হত বাদলের ঢাক বাজাবার সিজন। বিশ্বকর্মা পূজার পর দূর্গাপূজা, তারপর লক্ষ্মীপূজা, তারপর কালীপূজা— পরপর ঢাক বাজাবার বায়না ধরত বাদল। বাড়ি যখন ফিরত, তখন সঙ্গে নতুন গামছা, নতুন কাপড়, চাল আর বেশ কিছু নগদ টাকা। তারপর আবার নবান্নে অন্নপূর্ণা পূজা । মাঝে মাঝে সরস্বতী পূজাতেও ঢাক বাজানোর ডাক পেত বাদল। তাই সেবার বিশ্বকর্মা পূজার আগের দিন থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়াতে আকাশের সঙ্গে সঙ্গে মুখ গোমড়া হয়েছিল বাদলেরও।