নিজেকে তিনি বলতেন ‘কলম-পেষা মজুর’। নাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত তাঁর চতুর্থ উপন্যাস, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বিবেচিত হয় বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলোর একটি হিসেবে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘মাসিক পূর্বাশা’য় ধারাবাহিক হিসেবে যার প্রথম প্রকাশ। একের পর এক রূপকে তিনি তুলে এনেছেন চাষি-মজুর- মাঝি-মাল্লা-বাগদিদের ‘বিরাট মানবতা’কে, বাংলাসাহিত্যে। পদ্মাপাড়ের জেলেপল্লি- কেতুপুর গ্রামের নর-নারীর প্রাত্যহিক জীবনচর্যার কাহিনি। কোথাও আতিশয্য নেই, অতিরঞ্জন নেই- দুঃখকে যেমন মানিক অকারণে বাড়িয়ে দেখাননি, সুখকে তেমনি অপ্রাপ্য মহিমাও দেননি- শিল্পের চেয়ে জীবনই তাঁর কাছে কঠিনতম সত্য। কিন্তু সে জীবনে স্বপ্ন ছিল। তাই তো হোসেন আলীর চোখে ময়নাদ্বীপে নতুন জীবনের স্বপ্ন আঁকলেন। রাখলেন কুবের মাঝি আর কপিলাকে। থকথকে কাদার ভেতর অঙ্কুরিত জীবনকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন, “কোনো দিকেই মাঝারি হবার সৌভাগ্য নিয়ে তিনি আসেননি। চূড়াও যেমন তাঁর মেঘ-লোক ছাড়ানো, খাদও তেমনই অতল গভীর।” তাঁর মৃত্যুর সাত দশক পরেও তাঁকে নিয়ে, মানিকের লেখা নিয়ে লেখালেখি, বিতর্ক বহমান। তৈরিই হয়ে গেছে সমালোচনা-সাহিত্যের বড় একটি ধারা।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।