সমকালীন বাংলা সাহিত্যে মুসা আল হাফিজ অসামান্য উজ্জ্বলতার এক হীরকনাম। মানুষের অস্তিত্বসিন্ধুর উপরে-নিচে তাঁর সন্তরণ। জীবনের মর্মমূলের ব্যাপ্তির মতো পরিসরে ঈশ্বরে সমর্পণের ছলছল শব্দে অন্ধকারের ঘুম ভেঙে দিতে থাকা এক স্রোতের নাম তাঁর কবিতা। তাঁর মোহময় শব্দচিত্রে মায়াবীলোকের জ্বলজ্বলে অর্থবিন্যাস আছে। পড়তে গেলে ডুবে যেতে হয়। সৌন্দর্য ও দর্শনই তাঁর কবিতার প্রধান উদ্দীপক। যেন জীবনকে কতোভাবে দেখেছেন কবি। সেই দেখাকে ছেনে শিল্প-স্বভাবের মাদল বাজিয়েছেন কবিতায়। এ কবির মনের পরিচালক ও ভিত্তিভ‚মি প্রাচ্যের ঐশী-ঐতিহ্য। তাঁর মনোস্বভাব ঔপনিবেশিক মনোশাসনের বৈরী। অতলস্পর্শী বোধশক্তির মতো নিজস্ব এক চরাচরে এই কবি সমকালীন মেকি অনুভবের আবরণ ঠেলে মৃত্তিকা ও ইতিহাসের আত্মাকে মিস্টিক সংবেদে দেন প্রগাঢ় উচ্চারণ। সুগভীর অভিজ্ঞান ও কাব্যিক সারবত্তা মুসা আল হাফিজের স্বাতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে। কালজ্ঞানের প্রজ্ঞাদৃষ্টি নিয়ে এই কবি চলমান গড্ডল থেকে আলাদা হয়ে কালোত্তর দিগন্তের নম্র-নীল জ্যোৎস্নায় পাখনা ছড়িয়েছেন। এর শক্তিমত্ত দলিল তাঁর কবিতার আত্মায় আছে, শরীরে আছে। মুসা আল হাফিজের ১০০ কবিতা পাঠ থেকে অতলান্ত শিহরণে জীবনের অধরা মাধুরিদেশে সন্তরণের অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে যায়। এর মধ্যে নিহিত থাকে এক অনাস্বাদিতপূর্ব স্বাদ, যাকে বুঝাতে চাইলে বলা যায়, সেটা হলো ফিলিং অব বিলংগিংনেস, ফিলিং অব লস। মানে যা ছিল আবার নাই । কিন্তু যা নাই হয়েও আছে। তবে এটাও সত্য যে, মায়ানুভ‚তির জগতটাই এই কবির একমাত্র পৃথিবী নয়। ছোট ছোট অনেক পৃথিবী আছে মুসা আল হাফিজের পৃথিবীতে। জগতে যা মিথ্যা ও কদর্য, তার প্রতি নির্লিপ্ত সহনশীল নন এই কবি। সকল অসঙ্গতিকে তিনি মনীষার প্রতিক্রিয়া দিয়ে আঘাত করেছেন প্রখর। সেখানেও তার বিক্রম আতীব্র। এ কবির আগুন বড় বেশি পোড়ায়। কিন্তু সে আগুনের রং সবুজ। বাহ্যবয়নের রূপময়তায়, অন্তর্বস্তুর অবর্ণনীয়তায়, প্রতীকী প্রবণতার অবচেতনায়, সুফিসংরাগের অবিচ্ছেদ্যতায় মুসা আল হাফিজের কবিতার সম্মোহন যে কোনো মগ্নমনের পাঠককে উপহার দেবে জীবনের ভাববীজ-শস্যস্বাদ। ‘১০০ কবিতা’ গ্রন্থকে বলা যায় তারই সজ্জিত সঞ্চয়। বইটির পাতায় পাতায় আছে তারই উপাদেয় সুসমাচার। হারুন উর রশিদ
কবি, গবেষক ও আলেম মুসা আল হাফিজ। ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের মাখর-গাঁও গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৯৫ সালে, ১১ বছর বয়সে কুরআন মজিদের হিফজ সম্পন্ন করেন। ২০০৭ সালে কৃতীত্বের সাথে তাকমিল ফিল হাদীস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেন। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ তরুণ আলেম প্রতিভা-২০০৮ এ সম্মানীত হন। ২০০৯ সালে কর্মজীবনের শুরু ঐতিহ্যবাহী বিশ্বনাথ জামেয়া মাদানিয়ায় শিক্ষকতা এবং মাসিক আল ফারুকের উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ২০১৬ সালে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়াতুল খায়র আল ইসলামীয়া সিলেটে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৯ সালে ঢাকায়, যাত্রাবাড়ীতে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী দা‘ওয়াহ ও গবেষণা কেন্দ্র মা‘হাদুল ফিকরি ওয়াদদিরাসাতিল ইসলামিয়া। বর্তমানে ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করছেন। ২০১১ সালে হয় তার কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় কবি-সমালোচক মুকুল চৌধুরীর সনাক্তধর্মী আলোচনা ‘মুসা আল হাফিজ: কবিতার নতুন কণ্ঠস্বর’। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. রিজাউল ইসলাম তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে লিখেন গবেষণাগ্রন্থ- মুসা আল হাফিজের মননবিশ্ব (২০১৮)। তরুণ কবি এম আসাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিশজন আলোচকের পর্যালোচনাগ্রন্থ ‘মননের কবি, বৈদগ্ধের দৃষ্টিতে’। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ৫০টির অধিক বই লিখেছেন।