"ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: বসন্তের এক নিষ্ঠুর ভােরে ঘুম ভেঙে রাশেদ দেখতে পায় ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেমে এসেছে অন্ধকার ঘােষিত হয়েছে সামরিক শাসন; তার পাঁচ বছরের মেয়ে মৃদু ইস্কুলে গিয়েছিলাে, কিন্তু তাকে যেতে দেয়া হয় নি, মিলিটারিরা রাইফেল উঁচিয়ে তাকে বাধা দেয়, সে এই অদ্ভুত মানুষদের দেখে রাস্তা থেকে চোখ আর বুক ভরে দুঃস্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। রাশেদের হৃদয়ের মতাে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল আর মৃদুর কাজলাদিদি লুপ্ত হয়ে যায়। কর্কশ অশ্লীল সামরিক অন্ধকারে। তবে এই প্রথম সামরিক গ্রাসে পড়ে নি তার নষ্টভ্রষ্ট দেশটি, রাশেদের বাল্যকাল আর যৌবন নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে পাকিস্থানি সামরিক ঘাসে, এখন তার উত্তরাধিকারীর জীবনও পড়ে সামরিক গ্রাসে। রাশেদ জেগে ওঠে এক দূষিত বাস্তবতার মধ্যে, দিকে দিকে সে বুটের শব্দ শুনতে পায়, সে শুনতে পায় একনায়কের চাবুকের শব্দে নাচছে তার মাতৃভূমি, দেখতে পায় তার আত্মার মতাে প্রিয় দেশটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একনায়কের গ্রাসে পড়ে; তবে রাশেদ শুধু এ-দৃশ্যই দেখে.. না—দেখে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের সবুজ দাবাগ্নিদগ্ধ দেশটিকে কেউ ভালােবাসে না, যদিও সম্ভোগ করতে চায় সবাই। রাশেদ দেখতে পায় তার দেশটিকে নষ্ট করে চলছে সামরিক একনায়কেরা, ভ্রষ্ট করে চলছে রাজনীতিকেরা; এবং প্রতিটি মানুষ হয়ে উঠছে। বিপন্ন, একদিন রাশেদও বিপন্ন হয়ে ওঠে ভয়ংকরভাবে, নিজের চোখের সামনে দেখে পুড়ছে ছাই হচ্ছে ছাপ্পান্নো হাজার। বর্গমাইল—পুড়ছে গাছের পাতা, নদী, মেঘ, ধানখেত, লাঙ্গল, সড়ক, গ্রাম, শহর, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে একটি জাতি, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে বর্তমান, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ। হুমায়ুন আজাদ ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল-এ কোনাে ব্যক্তির কথা বলেন নি, বলেছেন একটি দেশ ও জাতির কথা, বলেছেন অভিনব রীতিতে, অসামান্য গদ্যে; তিনি উপস্থাপন করেছেন এক মর্মস্পর্শী ভূভাগের বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎকেও। ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের এ-ভূখণ্ডটি নিয়ে আগে আর কেউ এমন দুঃসাহসী হন নি সত্যকে এমন অকপটে প্রকাশের; হুমায়ুন আজাদ। সে-সত্য প্রকাশ করেছেন, রচনা করেছেন এক অভিনব উপন্যাস, যা শৈল্পিক সৌন্দর্যে অতুলনীয়।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।