‘সাত সাগরের মাঝি’র কবি ফররুখ আহমদের নিজের ভেতরেই একজন মাঝি ছিলেন- নাবিকও বলা চলে; দুঃসাহসী ও পরাজয় মানতে অসম্মত। ১৯৪৪ সালে বইটি যখন প্রকাশিত হয়, কবির বয়স তখন মাত্র ছাব্বিশ। যৌবনের সেই প্রাণোদ্দীপনা পুরোপুরি রয়েছে এ বইতে। বস্তুত এটি একটি অনবদ্য রচনা। এ রকমের একটি বই তাঁর প্রজন্মের অন্য কোনো বাঙালী কবি লিখতে পারতেন না, লেখেনওনি; এমনকি ফররুখ আহমদ পরবর্তীকালে নিজেও আর লেখেননি; এটিই তাঁর প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বই; যদিও তিনি এরপরে আরও লিখেছেন, প্রচুরই বলা চলে। দ্বিতীয়বার কেন লিখতে পারলেন না, তার কারণ যেমন অন্তর্গত, তেমনি বস্তুগতও। বস্তুগতই অধিক মাত্রায়। সময়টি ছিল অস্থির; সেই সময়টাকে তিনি ধারণ করেছেন, তাকে অভিব্যক্ত করেছেন; ওই সময়টা তো আর দ্বিতীয়বার আসেনি। কিন্তু সময় আবার বৈরীও ছিল; বৈরিতার কথা এ বইতে আছে, পরে ওই বৈরিতা আরও বেড়েছে। ফররুখ আহমদ বদলাননি, তাঁর শিরদাঁড়া ছিল অত্যন্ত শক্ত; কিন্তু সময় বদলেছে, এই বদলানোকে তিনি আর ধারণ করতে পারেননি। তিনি ছিলেন ইসলামসম্মত সাম্যবাদে বিশ্বাসী, ওদিকে সময় এগুচ্ছিল পুঁজিবাদী কায়দায়। এর বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন; সে লড়াইয়ের ফল তাঁর পরবর্তীকালের রচনাতে আছে। ওই লড়াইটা তাঁর ভেতরকার রোমান্টিকতাকে পরাভূত করতে পারেনি বটে, তবে ত্যক্তবিরক্ত করেছে। তাঁর ছিল শুভ-অশুভের অনমনীয় বোধ, অশুভকে দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ রচনা লিখেছেন এবং একটি নাটকও লিখেছিলেন। কাব্য নাটক, সনেট, মহাকাব্যিক দীর্ঘ কবিতা সবই আমরা পেলাম; কিন্তু দ্বিতীয় একটি ‘সাত সাগরের মাঝি’ আর পাওয়া গেল না। নির্মম সময় ও সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম তাঁর জগৎটাকে সঙ্কীর্ণ করে দিল। ফলে সাগরে আর নতুন জোয়ার এলো না।
ফররুখ আহমদের জন্ম -জুন ১০, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে (তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার। ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। এই বাঙালি কবি 'মুসলিম রেনেসাঁর কবি' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক "প্রাইড অব পারফরমেন্স" এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাঁকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। তিনি অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪ সালে মৃত্যু বরণ করেন।