মহাকালের গভীরে পৃথিবীর বাসযোগ্য পরিবেশ নগণ্য-সময়ের হলেও বিন্দুতে সিন্ধু রচনার প্রত্যয়ে তাতেই প্রাণ-নিষ্প্রাণের নির্বিঘœ অবস্থানের প্রচেষ্টা অন্তহীন। কখনো বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো একে অপরের প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে, আবার কখনোবা সম্মিলিতভাবে অস্তিত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।
কিন্তু প্রচেষ্টা চিরকাল প্রচেষ্টাই, একচ্ছত্র সফলতা পায় না কেউ―না প্রকৃতি, না প্রাণিকুল। প্রকৃতির সাথে তাই মানবজাতির একটি অদৃশ্য বিচ্ছেদ চিরকালের। এ এক নিরুত্তাপ প্রতিদ্বন্ধিতা, যার কোনো সমাপ্তি নেই। জীবন যেখানে সত্য, প্রকৃতি যেখানে উজ্জীবিত সেখানেই আধিপত্য বিস্তারের উন্মাদনা।
মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হস্তক্ষেপ করে প্রকৃতির অধিকারে, প্রকৃতি হানা দেয় মানুষের অস্তিত্বে। চলে সীমারেখা অতিক্রমের পালাক্রম। ঘুরেফিরে চরম মূল্য গুনতে হয় মানুষকেই―খরা, বন্যা, ভ‚মিকম্প কিংবা মহামারি-অতিমারিতে কোণঠাসা হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে বারবার, আর কেবল তখনই স্মরণে আসে তার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কতটা মজবুত আর কতটা ঠুনকো।
আমরা পঞ্চাশ পেরোনো মানুষ ইতিপূর্বে মহামারির কথা শুনেছি, দেখিনি। আর পরের প্রজন্মের অনেকে শোনেওনি। প্লেগ, কলেরা, স্মলপক্স, ফ্লু, ইবোলা ভাইরাস ইত্যাদি কখনো বিশেষ বিশেষ স্থানে আবার কখনোবা সারা বিশ্বে হানা দিয়ে জনমানব পাতলা করে গেছে পাতাঝরা বৃক্ষের মতো। তাতে কারো কিছু করার থাকত না একটার পর একটা লাশ সৎকার করা ছাড়া। কখনো কখনো সেটাও সম্ভব হতো না। বর্তমান কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে তার কিছুটা চিত্র দেখতে পাচ্ছে বিশ্ব।
চিত্রটাকে আরো খানিকটা স্পষ্ট করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা আমার। উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ওয়েবসাইট, কিছু বইয়ের পিডিএফ কপি, পত্রপত্রিকায় ছাপানো লেখা এবং হাতের কাছে থাকা যৎসামান্য বই প্রবল উৎসাহ দিয়েছে আমাকে। তথ্য পরিবেশনে নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি রয়েছে। জীববিজ্ঞান-চিকিৎসাবিজ্ঞানের জটিল শব্দমালা কেটেছেঁটে যতটা পারা যায় সহজীকরণ অথচ মূলবক্তব্য না-হারায় সে দৃষ্টিও ছিল।
পাঠকের অনুধাবনের সুবিধার্থে কিছু বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রতিটি নিবন্ধের শেষে পাদটীকায় সংযোজন করা হয়েছে। সকল মহামারির বর্ণনা কষ্টকর এবং তা বইয়ের কলেবর ও পাঠবিমুখতা বৃদ্ধি করতে পারত বিধায় সালের ঊর্ধ্বক্রমে সাজানো বড় মাপের কয়েকটি মহামারি ও অতিমারির আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দের প্লেগ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০২০ সালের কোভিড-১৯ পর্যন্ত চিহ্নিত মড়কগুলো আলোচনার মূলক্ষেত্র। তবে এসব মড়ক যেসব অণুজীব কর্তৃক সৃষ্ট, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সম্পর্কিত আলোচনা প্রথমে সেরে নেওয়া হয়েছে। সালভিত্তিক অতিমারি ও মহামারির একটি লম্বা তালিকা পরিশিষ্টে সংযোজন উৎসুক পাঠকের অনেক উপকারে আসতে পারে বলে আমার ধারণা। কিছু ভুলত্রুটি অনাকাক্সিক্ষতভাবেই থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়, সে জন্য শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি।
টাঙ্গাইল জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের থানা নাগরপুর। এরই দক্ষিণ সীমানা ঘেঁষা এক নিভৃত পল্লির অজপাড়াগাঁ বাড়িগ্রাম। যোগাযোগ অত্যন্ত নাজুক। এ গ্রামে ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে অতি সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলী হাসান। বাবা মরহুম মারফত আলী ব্যবসায়ী, মা মোছাম্মত জিরাতন্নেছা অত্যন্ত মেধাবী ও হস্তশিল্পে পারদর্শী। মায়ের প্রচেষ্টায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর অতিক্রম করে নাগরপুর কলেজ থেকে ১৯৮৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যয়ন শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম এবং নাট্যগোষ্ঠির সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটে। লেখালেখি শুরুও তখন থেকেই। ১৯৮৮ সালে স্নাতক এবং ১৯৮৯ সালে নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত। বর্তমান গ্রন্থের অনেকগুলো প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম সম্পাদিত ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’, ‘দৈনিক প্রথম আলো’, ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত।