জালালুদ্দীন রুমি অসংখ্য কবিতার সাধারণ প্রতিপাদ্য প্রেম। যেমন, ‘প্রেম হচ্ছে জীবনের সঞ্জীবনী’ কবিতায় রুমি বলেছেন যে প্রেম ছাড়া কোনো জীবন আদৌ কোনো জীবন নয়। তিনি তাঁর কবিতাকে ব্যবহার করেছেন প্রেমের তাৎপর্য বোঝানোর জন্য। রুমির কবিতায় প্রেমের ভূমিকা এত বেশি যে অনেক সময় প্রেম কোনো বেনামী চরিত্র। যেমন, তিনি যখন বলেন, ‘আমার অনিন্দ্য মুখশ্রীর প্রেয়সী কোথায় গেছে?’ তখন প্রেমকে মনে হয়, যেন কোনো প্রতিপক্ষ। বর্ণনাকারী তার প্রেয়সীকে এত ভালোবাসেন যে তিনি যখন নিরুদ্দেশ হয়ে যান তখন তার প্রেয়সী আক্ষরিক অর্থেই কোনো জাগতিক কাজকর্ম সম্পন্ন করতে অসমর্থ হয়ে পড়েন। সেজন্য রুমির বক্তব্য অনুযায়ী প্রেম জটিল এক আবেগ, এটি এমন এক আবেগ, যা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এই প্রেমই আমাদের হৃদয় ও আত্মায় প্রচ- আঘাত হানতে পারে।
প্রেমের মতো রুমির কবিতায় আল্লাহ’র ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রুমি বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ প্রত্যেকের জীবিকা ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি অনুভব করতেন যে, এমন বিশ্বাস করা ধর্মদ্রোহমূলক বা মূর্খতা যে কোনো মানুষের পক্ষে নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন, সীমাবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করতেন আল্লাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের উচিত বিনা দ্বিধায় এ সত্য স্বীকার করা। এছাড়া রুমি প্রেম ও আল্লাহ’র মধ্যে সমান্তরাল রেখা টেনেছেন এবং বলেছেন, ‘প্রেম হচ্ছে প্রভু!’ তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে প্রেমের সংজ্ঞাই হলো ‘আল্লাহ’।
আমাদের প্রত্যেকের জন্য তাঁর একটি পরিকল্পনা রয়েছে এবং আল্লাহ স্বয়ং তা তৈরি করেছেন প্রেম ও সেবার স্থান থেকে। সংক্ষেপে বলা যায়, রুমি তাঁর কবিতা প্রয়োগ করেছেন একথা বলতে যে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রেমময় এবং সর্বশক্তিমান এক অস্তিত্ব, যাঁকে আমাদের গ্রহণ ও মান্য করতে হবে। তিনি তাঁর অন্যান্য প্রতিপাদ্যের মধ্যে বরং ভাগ্যের পরজাগতিক ধারণা ব্যবহার করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে মানুষের এমন বিশ্বাস করার মতো মূর্খতা দেখানো উচিত নয় যে আমরা আমাদের জীবনকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। যদিও ভাগ্য বা অদৃষ্টের ধারণা তাঁর একটি কবিতায় প্রেমকে প্রভু বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাঁর অনেক কবিতায় প্রবলভাবে অনুভূত হয় প্রেমের উপস্থিতি। প্রেম ও আল্লাহকে নিয়ে রুমির আলোচনা সুস্পষ্টভাবে অদৃষ্টের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। কারণ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেকের ভাগ্য আল্লাহ’র হাতে। রুমি তাঁর কবিতাকে ব্যবহার করেছেন মানুষকে এ সত্য বোঝাতে যে ভাগ্য বা অদৃষ্ট কিছুতেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (ফার্সি: جلالالدین محمد رومی; ৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭ – ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩), যিনি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ বালখী, মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি নামে তবে শুধু মাত্র রুমি নামেও পরিচিত, ১৩শ শতাব্দীর একজন ফার্সি[৭][৮] সুন্নি[৯] মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিয়বাদী এবং সুফী ছিলেন।[১০] রুমির প্রভাব দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়েছে; ফার্সি, তাজাকিস্তানি, তুর্কি, গ্রিক, পশতুন, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা বিগত সাত শতক ধরে বেশ ভালভাবেই তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে সমাদৃত করে আসছে।[১১] তার কবিতা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের “সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি” [১২] এবং “সর্বাধিক বিক্রীত কবি” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[১৩][১৪] রুমির সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও তিনি অনেক স্তবক তুর্কি, আরবি এবং গ্রিক ভাষায়ও[১৫][১৬][১৭] রচনা করেছেন। [১৮][১৯] তার লেখা মসনবী-কে ফার্সি ভাষায় লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়।[২০][২১] বৃহত্তর ইরান এবং বিশ্বের ফার্সি ভাষী জনগোষ্ঠী এখনও তার লেখাগুলো মূল ভাষায় ব্যাপকভাবে পড়ে থাকে।[২২][২৩] অনুবাদসমূহও খুব জনপ্রিয়, বিশেষ করে তুরস্ক, আজারবাইজান, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ এশিয়ায়।[২৪] তার কবিতা ফার্সি সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে, শুধু তাই নয় তুর্কি সাহিত্য, উসমানীয় তুর্কি সাহিত্য, আজারবাইজানি সাহিত্য, পাঞ্জাবের কবিতা, হিন্দী সাহিত্য, উর্দু সাহিত্যকেও অনেক প্রভাবিত করেছে। এছাড়াও অন্যান্য ভাষার সাহিত্য যেমন তুর্কীয়, ইরানীয়, ইন্দো-আর্য, চাগাতাই, পশতু এবং বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। তার জীবনদর্শনের উপর শিবলী নোমানীর রচিত সাওয়ানেহে মাওলানা রূম অন্যতম। নাম