সিমন দ্য বোভোয়া, নাম শুনলেই প্রথমে মাথায় আসে- আরে! উনি তো নারীবাদী ছিলেন কিংবা উনি তো নারীবাদই একপ্রকার গইড়া দিছেন। অন্তত নারীবাদী হিসাবেই বোভোয়াকে সবাই চেনে। সবার মাথায় এইটাও থাকে- দ্য সেকেন্ড সেক্স (১৯৪৯) । তবে বোভোয়াকে নিয়া কথা বলতে গেলে আরও তিনটা শব্দ প্রথমেই আসবে- সার্ত্র, প্যারিস, ফ্রিডম। বোভোয়া জন্ম নিছিলেন ১৯০৮ সালের ৯ জানুয়ারি, প্যারিসে। তার বাবা একসময় অভিনেতা হইবার ইচ্ছা পোষণ করতেন, সেই সুবাদে করছেন থিয়েটার, পড়ছেন আইন, শেষে ঢুইকা পড়ছেন সিভিল সার্ভিসে লিগ্যাল এসিস্টেন্ট হিসাবে। অন্যদিকে মা ছিলেন ক্যাথলিক। তিনি বোভোয়ারেও চাইছিলেন, তিনি যেন একজন ক্যাথলিক ওয়েতে ধার্মিক হইয়া পড়েন। কিন্তু, চৌদ্দ বছরের একটা পার্টিকুলার ইভেন্টে বোভোয়া নাস্তিক হইয়া পড়েন। বোভোয়া একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন। একোলো নঘমান সুপেরিয়ে তিনি আর সার্ত্র ক্লাসমেট ছিলেন। ছিলেন ফিলোসফির কড়া মাল। তিনি এন্ট্রান্স এক্সামে সেকেন্ড হইছিলেন, সার্ত্র হইছিলেন ফার্স্ট। ওই সময়টা হইতেছে ধরেন ১৯২৯ এর দিকে। সেইখান থেকেই সার্ত্র আর বোভোয়া একে অপরের বন্ধু হইয়া পড়েন, লাভারও। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক অটুট ছিলো সার্ত্রের মৃত্যু পর্যন্ত। তাদের রিলেশানশিপ অনেকের জন্যে ওইসময় একপ্রকার আইডল হিসাবে দাঁড়াইছিলো। তারা একসাথে বসে প্যারিসের ক্যাফেতে বসে চুরুট টানতেছেন, লিখতেছেন বই, আর্টিকেল, মাঝে মাঝে একে অপরের সাথে কথা বলতেছেন। আবার দেখা যাইতেছে, সার্ত্রের সাথে সাথে বোভোয়া হাঁটতেছেন, পলিটিকাল লিফলেট বিলাইতেছেন, ঠিক সেই সময়ে পুলিশ আসলো। সার্ত্রকে ক্যারাভানে পুলিশ তুলতেছে, বোভোয়াও অবলীলায় ক্যারাভানে উঠে যাইতেছেন। বোভোয়া, সার্ত্র পাশাপাশি দুইটা এপার্টমেন্টে থাকতেন। সেইখানে বোভোয়া চলে আসতেন, নিরিবিলি তার মতো করে স্পেস নিয়া তিনি লিখতেন। বোভোয়া-সার্ত্রের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তো ছিলোই। তবে সেইটা প্রথার বাইরে, কনভেশনাল না। তারা একে অপরকে ভালোবাসলেও তাদের মধ্যে এমন একধরণের কমিটমেন্ট ছিলো, যাতে তারা ফ্রি ছিলেন অন্য আর যে কারোর সাথে সম্পর্কে জড়ায়া যাবার ক্ষেত্রে। এইটা ছিলো ওপেন রিলেশানশিপ। খুব ডিপ কোন কমিটমেন্টে তারা আটকে পড়ার মানুষ ছিলেন না। সার্ত্র-বোভোয়ার সম্পর্ক আরও ভালো কইরা বুঝা যাবে, তাদের দর্শন বা ফিলোসফির চর্চা দিয়া- এক্সিস্টেনশিয়ালিজম। প্রচলিত বাংলায় যার নাম অস্তিত্ববাদ। এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট সার্ত্রের মতে, মানুষ ফ্রি, স্বাধীন যেকোন কাজ করতে। এবং যে কাজই করে না কেন সে, সে বরং তাই হইয়া উঠে। মানুষ কোন এথিক্স, রিলিজিয়ন বা এইসব সোশ্যাল বোঝা দিয়া আবদ্ধ না। তবে এমন না যে, সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। হ্যাঁ, সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে তবে তার প্রতিটা কাজে পুরা মনুষ্যজাতিকে প্রতিনিধিত্ব করার একটা বার্ডেন থাকে। সে যাই করে, তার কাজের মাধ্যমে সে তো নিজেকে ডিফাইন করতেছেই। প্লাস পুরা মনুষ্যজাতিকেও একপ্রকার ডিফাইন করে দিতেছে তার কাজের মাধ্যমে। বোভোয়ার প্রথম পরিচয়, তিনি একজন মানুষ এবং একইসাথে এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট। তিনি নিজেকে প্রথমে নারীবাদী- এই ক্যাটাগরিতে ফেলান নাই। তিনি এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট ফিলোসফিকে কেস স্টাডি করে, একেবারে চোখে ধরায়া দেখায়া দিছেন যে আমরা কিভাবে প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে ডিফাইন করে চলি। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়া সংকটে পড়ি, ভেঙ্গে পড়ি বা আবার নিজেদের গড়ে তুলি। সার্ত্রের সাথে তার ফারাক হবার জায়গাটা হইতেছে, সার্ত্র যেইখানে ফ্রিডম, বিয়িং এই জিনিসগুলাকে খুব পার্স্পেক্টিভ আকারে তুলে ধরছেন, বোভোয়া সেইখানে সোসাইটির সাথে মানুষের স্বাধীনতার সম্পর্কটা আমাদের দেখাইছেন। যেমন, একজন নারী যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। তাকে সোসাইটির বিভিন্ন নর্মস, বাধার মধ্যে দিয়া যাইতে হয়। এইগুলা একজন নারীর অভ্যাস, চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুতেই প্রভাব ফেলে। তবু এই বাধার জায়গাগুলোতে কিভাবে একজন নারী কাজ করে, তার একটা স্কেচ বোভোয়া আমাদের তার ফিকশান, ননফিকশান সবখানেই দেখানোর চেষ্টা করছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হইতেছে, বোভোয়া বা সার্ত্র দুইজনের কেউই বলেন নাই, একজন মানুষের কী হওয়া উচিত। বরং একজন মানুষ কিভাবে কী হইয়া উঠে সেইটার দিকেই তাদের বেশি ইন্টারেস্ট। কারণ, এক্সিস্টেনশিয়ালিজম তাই বলে। আপনাকে তা কোনকিছু প্রেস্ক্রাইব করেন না। বরং আপনার অস্তিত্ব, সত্তা কী হয়ে উঠতেছে, চয়েজের মাধ্যমে (সার্ত্র), সোসাইটির মাধ্যমে (বোভোয়া), পারসেপশনের মাধ্যমে (পন্ত) তা ব্যাখা করবার জায়গাটা জাস্ট তৈরি করে দিতেছে। সার্ত্র যেইখানে প্রশ্ন তুলতেছেন, “একটা কাজ থেইকা আরেকটা কাজ বেটার তা কিভাবে বলা যায়?” সেইখানে বোভোয়া সার্ত্রের এই প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন কান্টিয়ান স্টাইলে, “বেটার কিভাবে বলব বা এইটা বলবার কে আছে?” একজনের কাজের মোরাল ভ্যালু- তার নিজের সাথে কাজটা যে ফ্রিডমের সম্পর্ক তৈরি করতেছে বা অন্যদের সাথে ফ্রিডমের যে সম্পর্ক তৈরি হইতেছে- তার ভিতরেই নিহিত। বোভোয়ার এই ফিলোসফিটা মাথায় রাখবার মতো।