আমি খেয়াল কইরা দেখছি যে, কাউরে নিয়া, বিশেষ কইরা কবি সাহিত্যিকদের নিয়া লিখতে গেলেই তাদের জন্মসাল দিয়া লেখা শুরু করার একটা মার্শাল ল’র মতন ব্যাপার আছে। যাই হোক, চিনুয়া আচেবের ইন্টারভিউয়ের অনুবাদ নিয়া দু-চারটা খচুরা আলাপ পাড়তে গিয়া সেইটা মানব না ভাবছিলাম কিন্তু তা আর হইল না, কারণ তার জন্মসালটা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩০ সালে, মানে তার জন্মের সময় নাইজেরিয়া ছিল পরাধীন একটা দেশ। ইংল্যান্ডের একটা কলোনি ছিল তারা। দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ওগিদিতে জন্মানো আচেবে ছিলেন ইগবো গোত্রের লোক। তার পূর্বপুরুষেরা বাপ-দাদাদের ধর্ম ছাইড়া খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছিলেন বহু আগেই। ফলে খ্রিস্টান পরিবারেই তার বাইড়া ওঠা। যদিও ইন্টারভিউটাতে তার বা তার পরিবারের এই জার্নি নিয়া খবু একটা আলাপ নাই। শুধু একটা জায়গায় আছে যে, তার বাবা যাজক হিসাবে নাইজেরিয়ায় নানান জায়গায় তাদের নিয়া ঘুরে বেড়াইছেন বহু বছর। আচেবে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। ফলে স্কুল-কলেজ শেষে তিনি স্কলারশিপে ডাক্তারি পড়ারও সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু তা না পইড়া উনি বিখ্যাত ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন বইলা ঠিক করেন। ফলে স্কলারশিপটা মাঠে মারা যায়। নাইজেরিয়ার ইতিহাসে ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আমাদের দেশের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই। আচেবের থেকে বয়সে চার বছরের ছোট ওলে সোয়িংকাও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র, যিনি পরে গিয়া নোবেল প্রাইজ পাইছিলেন। আসলে নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার পেছনে এই জায়গার অনেক অবদান আছে। তো যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আচেবের লেখালেখি শুরু। ঔপনিবেশিক শাসনে বাইড়া ওঠা আর দশটা শিক্ষিত পোলাপানের মতো আচেবেও নিজের দেশ-জাতি-ভাষা নিয়া ধীরে ধীরে সচেতন হইয়া উঠতে শুরু করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল উনার সব লেখালেখির ইংরেজিতে। সেইটা কেমনে হইল এইটার একটা মজার ব্যাখ্যাও এই ইন্টারভিউটায় আছে। খ্রিস্টান মিশনারিরা কেমনে উইড়া আইসা জুইড়া বইসা তাদের ভাষাটার দফারফা কইরা দিছিল, তা ওই জায়গাটা পড়লেই টের পাওয়া যায়। আর এগুলা যে সাম্রা জ্যবাদী আগ্রাসনের চিরাচরিত অভ্যাস তা আচেবে ঠিকই জানতেন। এগুলার পাশাপাশি জীবনের নানান কিসিমের তিতা অভিজ্ঞতা, কলোনিয়াল নাক উঁচা ভাবসাব, বর্ণবাদ ইত্যাদি তো আছেই। ঔপনিবেশিক লুটতরাজ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর পোস্ট কলোনিয়াল যুগে নিজেদের পুটকি মারামারির দিক দিয়া আফ্রিকা আর ইন্ডিয়ান উপমহাদেশের মারাত্মক মিল। এই দুইটা জায়গাতেই ওই দুই সময়ে দুর্দান্ত সব সাহিত্যিকদের দেখা পাওয়া গেছিল। আচেবেও তেমনি একজন। ইনারা আসলে একটা বিশাল স্কেলের আগ্রাসনের বাইপ্রোডাক্ট। আধুিনক আফিকান সাহিত্যের প্রথম দিককার মায়েস্ত্রোদের মতো আচেবের লেখাও মলূ ত নিজেদের শিকড়ের দিকে ফোকাসড। হাজার হাজার বছরের পুরান আফ্রিকান রূপকথা, প্রবাদ-প্রবচন, পুরুষের মতো বা কখনো কখনো পুরুষের চাইতেও শক্তিশালী নারীই তার অধিকাংশ লেখার নিউক্লিয়াস। থিংস ফল অ্যাপার্ট তার প্রথম বিখ্যাত কাজ। তবে এতটা শিকড় সচেতন হইয়াও তিনি যে এলিয়টরে এড়াইতে পারেন নাই, তা উপন্যাসটার নাম দেখলেই টের পাওয়া যায়। আর এইটার ব্যাখ্যাও আচেবে এই ইন্টারভিউয়ে দিছেন। তবে এইটাও ঠিক যে, ধার করা নাম হইলেও তা উপন্যাসটার গায়ে দাগ লাগাইতে পারে নাই এতটুকু। এই ইন্টারভিউয়ে আচেবের জীবনের একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়া কোনো প্রশ্ন নাই। তা হইল বায়াফ্রা। ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রা নামের একটা অ ল নিজেদের স্বাধীন বইলা ঘোষণা করে। আচেবে তাদের সমর্থন জানান। তিন বছর মারামারি-কাটাকাটি চলার পর নাইজেরিয়া সরকার আবার অ লটা নিজেদের দখলে নিয়া নেয়। এতদিন শাসন-শোষণে কাটানো একটা দেশের বুদ্ধিজীবী হইয়াও এরকম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয়াটা কিন্তু যা তা কথা না! আচেবের এই জিনিসটা আমার ভাল্লাগছে। আর এই সিদ্ধান্তটা যে তার ক্যারিয়ারেরও ক্ষতি করছিল তাও একটু মাথা খেলাইলেই বোঝা যায়। মানুষ হিসাবে যে তিনি যথেষ্ট ঠোঁটকাটা ছিলেন তা জোসেফ কনরাডের লেখা নিয়া করা তার অ্যান ইমেজ অফ আফ্রিকা: রেসিজম ইন কনরাড’স ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ শিরোনামের সমালোচনা পড়লেই বোঝা যায়। ফলে বেশ কয়েকটা জোশ উপন্যাস লেখেও তার কপালে নোবেল জোটে নাই। অথচ ওলে সোয়িংকা পাইছিলেন ঠিকই। বিতর্ক করার জন্যে বলতেছি না, তবে ২০১৩-তে আচেবে যখন মারা যান, তখন আফ্রিকায় তার নোবেল না পাওয়া নিয়া অনেক কথা উঠছিল। আর বলতে দ্বিধা নাই যে, আচেবের সেই নামকাওয়াস্তে সমর্থকেরা ব্যাপারটারে আসলেই নোংরামির পর্যায়ে নিয়া যান। তো তখন সোয়িংকা দ্য গার্ডিয়ান-এ দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে এই নোংরামি নিয়া অনেক কথা বলছিলেন। তবে এও বলছিলেন যে, বায়াফ্রা প্রশ্নে আচেবের অবস্থান একেবারেই পছন্দ না তার। এইটা নিয়া আচেবের লেখা বই দেয়ার ওয়াজ অ্যা কান্ট্রি : অ্যা পারসোনাল হিস্ট্রি অফ বায়াফ্রা বিষয়ে তিনি বলছিলেন যে, এরকম একটা বই যেন আমার কোনোদিন না লেখা লাগে! শেষ জীবনে আইসা আচেবে একটা খারাপ ধরনের গাড়ি দুর্ঘটনায় পইড়া মারাত্মক জখম হন। অপারেশন করা হয় তার শরীরে। বেঁচে গেলেও হুইল চেয়ারের জীবন মাইনা নিতে হয় তাকে। এরকম কিছুনা হইলে হয়তো জগতে আরও অনেকদিন পাওয়া যাইত তারে। যদিও আয়ুহিসাবে ৮২ বছর খুব একটা কম না! তানভীর হোসেন
নাইজেরিয়ার ওনিসা এলাকার কয়েক মাইল উত্তর-পূর্বে ওগিডি-তে চিনুয়া আচেবে জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে। তার বাবা ছিলেন গীর্জার দূত; তার মানে সপ্তাহের দিনগুলােতে তিনি মিশন স্কুলে পড়াতেন, আর একই সঙ্গে গ্রামের গীর্জার দায়িত্ব পালন করতেন। আচেবে-পরিবারের ছেলেমেয়েরাও মিশন স্কুলে পড়তাে, সেখান থেকেই চিনুয়া ভর্তি হয়েছিলেন উমুয়াহিয়া সরকারী কলেজে, ১৯৪৪ সালে। ১৯৪৮ সালে চিনুয়া ঢােকেন ইবাদানের বিশ্ববিদ্যালয়কলেজে, কলা-স্নাতক হন ১৯৫৩ সালে। তার পরে তিনি যােগ দেন নাইজেরীয় বেতার-ব্যবস্থায়, কথিকা- প্রস্তুতকারী হিসেবে। সেখানেই তিনি বেতারের বহির্দেশীয় প্রচারের পরিচালক হন, চলে যান লাগােসে। ১৯৫৮-১৯৬৬ সময়কালে চিনুয়া ৪টি উপন্যাস লেখেনথিংস ফল এ্যাপার্ট (১৯৫৮),নাে লঙার এ্যাট ইজ(১৯৬০), অ্যারৌ অব গড (১৯৬৪) এবং অম্যান অব দ’ পিপল (১৯৬৬)। ১৯৬৬ সালেই প্রকাশিত হয় চিকি আর নদী। পরবর্তীতে নানা ধারায় আরাে অনেক লেখেন চিনুয়া আচেবে। শুধু নাইজেরিয়ার নয়, গােটা আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্য-সৃষ্টির ধারাটিকেই গড়ে তােলেন তিনি তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ প্রয়াত হন চিনুয়া আচেবে।