বাংলা কবিতা ‘রূপে-রসে উজ্জ্বল ও বিচিত্র, পরিমানেও প্রচুর কিন্তু সকল ধারার কবিতা নিয়ে একটি মান্য সংকলনের অভাব বোধ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। একসময় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’—যা আজও অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনের মর্যাদায় ভূষিত। আধুনিক কবিতার কোনও একটি বিশেষ অংশে দৃষ্টি নিবদ্ধ না রেখে বুদ্ধদেব বসু চেয়েছিলেন ‘সমগ্র’ ধরা পড়ুক। সুধীন্দ্রনাথের মনীষিতার পাশাপাশি জীবনানন্দের দৃশ্যগন্ধময় নির্জন কান্তার যেমন থাকবে, তেমনই থাকবে বিষ্ণু দে-র অল্প বলার কৌশলের পাশেই অমিয় চক্রবর্তীর নিচু গলার হার্দ্য উচ্চারণ। থাকবে আধুনিক কালের প্রতিটি সম্পন্ন কবি। সাহিত্যকে কোনও ফর্মুলায় বাঁধা যায় না। আধুনিক কবিতাকে কোনও একটি-দু'টি চিহ্ন দ্বারা শনাক্ত করা অসম্ভব। স্রোতের তলায় আবর্ত থাকে অনেক। নানা কবির অবদানে আধুনিক কবিতার প্রবাহে মিশে আছে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, সংশয়, ক্লান্তি, সন্ধান, বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি আস্থা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, “আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা ও বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম ও আধ্যাত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে, শুধু ভিন্ন-ভিন্ন কবিতে নয়, কখনও হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।”
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।