ইসলামি চিন্তার জগতে ইমাম গাযযালী হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও মৌলিক চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন ইসলামি মতবাদের একজন বড় সংস্কারক ও দার্শনিক মতবাদের একজন সমালোচক। এই বিশ্বখ্যাত মনীষী ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪৫০ হিজরি সনে পারস্যের খোরাসন নামক প্রদেশের তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ইমাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তুসী আল গাযযালী। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আল-গাযযালী। কারও মতে ইমাম গাযযালীর বংশের লোকেরা সম্ভবত সুতার ব্যবসা করতেন, তাই তাঁদের বংশ উপাধি গাযযাল নামে পরিচিত। গাযযালী তাঁর পূর্ববর্তী চিন্তাবিদদের বিভিন্ন মতবাদের সমন্বয়ে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপ তুলে ধরেন বলে তাঁকে ‘হুজজাতুল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের রক্ষক বলা হয়। তুস নগরেই গাযযালী প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি জন্মভূমি তেহরান ছেড়ে জুরজান শহরে যান। যেখানে তিনি আবু নছর ইসমাইলের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর তিনি খোরাসনের অন্তর্গত নিশাপুর শহরের ‘নিযমিয়া মাদ্রাসা’র প্রধান শিক্ষক মহাজ্ঞানী আবদুল মালিকের নিকট জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি মৌলিক গবেষণার সঙ্গে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে বাগদাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নিযমিয়া মাদ্রাসার ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। এই মহামনীষী ১১১১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাস মোতাবেক ৫০৫ হিজরি সনে তাঁর নিজ জন্মভূমি তুস নগরে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম গাযযালী তত্ত্ববিদ্যা, নীতিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, সুফিতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে ছোট-বড় বাহাত্তরখানা গ্রন্থ রচনা করেন। তাত্ত্বিক দর্শনের ওপর তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী গ্রন্থ হলো ‘তহাফুতুল ফলাসিফা’। তিনি এই গ্রন্থে ‘ফলাসিফা’ চিন্তাগোষ্ঠীর দার্শনিকদের মতবাদসমূহ পর্যালোচনা করেন এবং তাঁদের মতবাদের প্রায় বিশটি সমস্যা তুলে ধরে তা খ-ন করেন।
বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ., সংক্ষেপে ইমাম গাজ্জালী ছিলেন একজন সুফিসাধক ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাবিদ, যিনি তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারা বিশ্ব মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর পারিবারিক ব্যবসা সুতা সংক্রান্ত হওয়ায়, সেখান থেকে তার নাম গাজ্জালী হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যেহেতু 'গাজ্জাল' শব্দের অর্থ সুতা। ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ৪৫০ সাল) ইমাম গাজ্জালী ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এই তুস নগরীতেই তার শৈশবকাল ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি ইসলামের স্বর্ণযুগে জন্ম নেন, যে যুগে শিক্ষা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে মুসলমানরা অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো। একইসাথে বিস্তার লাভ করেছিলো পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শনেরও। ইমাম গাজ্জালী এসকল বিষয়েই দীক্ষা লাভ করেন এবং বিশেষ করে ঐ যুগের বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির কাছ থেকে ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। মুসলিম দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ফিকহশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী । জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান বাগদাদের সেরা বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনা করেন। তিনি তৎকালীন বাদশাহর দরবারেও আসন লাভ করেন। তবে সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিষয়ে তীব্র আকর্ষণ থাকায় তিনি জ্ঞান আহরণের জন্য দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন ও নানা বিষয় সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। ইমাম গাজ্জালী রহ. বই রচনার মাধ্যমে তাঁর অর্জিত এসকল জ্ঞান মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ. এর বই সমূহ-তে তিনি আলোচনা করেছেন সুফিবাদ, ইসলামি দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে, এবং তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা চার শতাধিক। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ. এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'আসমাউল হুসনা', 'মিশকাতুল আনোয়ার', 'ফাতাওয়া', 'মিআর আল ইলম', 'হাকিকাতুর রুহু', 'দাকায়েকুল আখবার' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১১১১ খ্রিস্টাব্দে (৫০৫ হিজরি) তিনি নিজ জন্মভূমি তুস নগরীতে মৃত্যবরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় একজন মনীষী।