ফ্ল্যাপে লিখা কথা মনীষীদের জীবনের ইতিহাস নীরস তথ্যপঞ্জীর সংকলন মাত্র নয়। তাঁদের জীবনের বাহ্যরূপের অন্তরালে যে গভীরতম মনোজীবন আছে, তার স্বরূপ উদ্ঘাটনই যথার্থ জীবনীকারের লক্ষ্য। এ কাজ সম্ভবপর হয় জীবনীকারের ভঅবদৃষ্টির গ্রন্থনসূত্রে। যে জীবনীর কেন্দ্রশক্তি হচ্ছে ভাবসত্য, সেই জীবনীই সবসময় পাঠক-নন্দিত হয়।
তৎকালের খ্যাত-স্বল্পখ্যাত নানা ব্যক্তির চরিতবিষয়ক বহু রচনার রচয়িতা আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯)। তাঁর রচনায় ফেনিলতার পরিবর্তে রয়েছে বিশ্লেষণের একটি স্বতন্ত্র ভঙ্গি। নিজের ডায়েরির একটি জায়গায় (১৩ এপ্রিল ১৮৮৪) শিবনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের লেখকদিগের সংস্কার আছে যে জীবনচরিত লিখিতে হইলে বড় বড় লোকদিগেরই জীবনচরিত লেখা কর্তব্য-তোমার আমার মত লোকের জীবনচরিত আবার কি লিখিব। কিন্তু ইহা ভ্রম, যে কেহ সৎ পথে থাকিয়া নিজ পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের গুণে আপনার উন্নতি সাধন করিয়াছে, সে সকলেরই জীবনচরিত লেখা কর্তব্য।’
এই আদর্শের কথা স্মরণ করেই শিবনাথ খ্যাত-স্বল্পখ্যাত বহুজনের জীবনচরিত লিখে গেছেন। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ এমনতর এক জীবনীমালার অনবদ্য সংগ্রন্থন তথা উনিশশতকে বঙ্গদেশেল ইতিহাসের একখানি প্রামাণ্য দলিল।
এই গ্রন্থটিকে তথ্যবহুল ও ইতিহাসানুগ করার ব্যাপারে শাস্ত্রী মহাশয়ের যত্নের অবধিমাত্র ছিল না। এজন্যে তিনি প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বহু ঘটনার তিনি স্বয়ং-স্বাক্ষী। সেজন্যেই দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন (ভারতী, জ্যৈষ্ঠ ১৩১১, পৃ. ১৯১)- ‘এই ঘটনাবহুল অবস্থার বৈষম্য ও বিভিন্ন মতের প্রচারে বিচিত্রভাবে পুষ্ট, বিচ্ছন্দে বিকাশোন্মুখ যুগের ইতিহাস শাস্ত্রী মহাশয় নখদর্পনে দেখিয়াছেন। তিনি প্রাঞ্জল ও কৌতূহলোদ্দীপক সুন্দর ভাষার আকর্ষণে আমাদিগকে মুগ্ধের ন্যায় টানিয়া বিগত অর্ধ শতাব্দীর আবরণ উন্মোচন করিয়া দেখাইয়াছেন।’
‘১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দের চৈত্রমাসে বারূইহুদা গ্রামে মাতুলালয়ে লাহিড়ী মহাশয়ের জন্ম হয়।’ ১৮৯৮ সালের ১৩ই আগষ্ট তিনি পরলোকগমন করেন। রামতনুর দীর্ঘ পঁচাশি বছরের জীবনের বিবরণ লিখতে গিয়ে শিবনাথ তৎকালীন বঙ্গদেশের পতন-অভ্যুদয়ের রূপটিকে ভূমিকা হিসেবে অত্যন্ত সরলভাবে বর্ণনা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে দেশজীবনকে আশ্চর্যভাবে সমীকৃত করে, সমন্বায়িত করে শিবনাথ এমন এক অনবদ্য ইতিবৃত্ত রচনা করলেন যার প্রসিদ্ধি তর্কাতীত। আকরগ্রন্থ হিসেবেও এর মূল্য অপরিসীম। বস্তুতপক্ষে গ্রন্থটি বঙ্গদেশে শতাব্দিীব্যাপী অনুশীলিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবনার সমন্বায়িত ইতিহাস। গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদক স্যার রোপার লেথব্রিজ সঙ্গত কারণে মন্তব্য করেছেন -“The Pandit's work is quite the most scholarly book of its kind as well as the most serious and sustained effort to combine, in a biographica work, Oriental and Western modes of thought, that has yet appeared in Bengali".
ঐ সময়ের বড় মানুষের সঙ্ঘমনের একটা পরিচয়ও এখানে অতিপ্রত্যক্ষ হয়ে উটেছে। অসাধারণ নিরপেক্ষতা নিয়ে শিবনাথ এই গ্রন্থ রচনা করেছেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা হওয়া সত্ত্বেও।