ছোটগল্প ছোট নয়, বিন্দুর মধ্যে তা সিন্ধুকেও ধারণ করতে পারে। জায়েদ ফরিদ এমন একজন ছোটগল্পকার যার গল্প তেমনই এক শিল্পসম্ভব অনন্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ঘাসের ডগায় সারারাত ধরে জমে থাকা শিশিরবিন্দুতে যেমন সকালের সূর্য বিঘ্নিত হয়, তাঁর গল্পের অন্তলীন প্রেম-ভালোবাসার বোধও তেমনই প্রতিবিম্বিত হয় পাঠকের হৃদয়-আকাশে। জায়েদ ফরিদ পদ্মা-যমুনার জলধারার মিলনভূমি পাড়েল-ভাঙা পদ্মাতীরের ভূমিজ সন্তান। স্থপতি ও জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবে জীবনের বিদেশবিভূয়ে থেকেও পদ্মার অবিরল জলধারার মতোই লিখে গেছেন জীবন্ত ছোটগল্প। মানিক বন্দোপাধ্যায় যেমন পদ্মানদীর মাঝির ভিতর দিয়ে অতিকল্প ধ্রুপদী সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বভাবকৰি জায়েদও তার অননুকরণীয় গদ্যে এঁকেছেন গঙ্গা-পদ্মা প্রবাহে সেগুন কাঠের পানসিতে ভাসমান নর-নারীর প্রেম। তাঁর স্বকীয় কলমে একজন দরিদ্র জেলেবউ হয়ে উঠেছে মহাকাব্যিক 'গঙ্গাবউ'। জায়েদ ফরিদ, বাংলা ছোটগল্পে নতুন পাঠপ্রিয়তার জনক। ছোটগল্প নিয়ে তাঁর সৃষ্ট আপন সিন্ধুতেই বিরাজ করেন তিনি। বরাবর লক্ষ করি, বহুরৈখিক চারিত্র্যের সমাবেশ ও বিস্তার ঘটাতে তাঁর যেন ঘোর আপত্তি। শব্দমোহে আচ্ছন্ন হতেও তিনি দৃঢ়ভাবে অনীহ। নিরাভরণ রেখায় মূলগল্পবিন্দুতেই গভীরতা বিন্যাস করা তাঁর কাঙ্ক্ষা। প্রেম তাঁর কলমে বিচ্ছুরণ ঘটায় অবলীলাক্রমে। অনুভবের মূল-বিন্দুকে বিকশিত করতেই তিনি স্বভাবসিদ্ধ । দেশ-কাল-পাত্র-পাত্রীকে যৎকিঞ্চিত ছুঁয়েই তিনি ফুটিয়ে তুলতে তৎপর অনুভবের গোলাপ যা রবীন্দ্রভাববাচ্যের অনুধর্মা পরিণতি পেতে চায়। এই তাঁর পাঠপ্রিয়তার চাবি। জায়েদ ফরিদের গল্প সরল শিল্পরূপ সৃষ্টিতে অতিপরিমিতিবোধ ও ভাষাদক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। দীর্ঘকাল পর বাংলার সাহিত্যজগতে ছোটগল্পের আঙ্গিকে এ এক নতুন সংযোজন। —কুয়াত ইল ইসলাম।
জন্ম ১৯৪৮ সালে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে এক বিমিশ্র প্রাকৃতিক ঠিকানায় যার সামনে পদ্মা, পেছনে যমুনা, মাঝখানে কাশবন, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এবং বন-জঙ্গল। গাঙ্গেয় শুশুকের সঙ্গে সাঁতার কেটে আর বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বড় হয়েছেন তিনি। শৈশবের দুরন্ত জায়েদের প্রথমপাঠ পাবনায় শুরু হলেও পরবর্তীকালে পিতার চাকরিসূত্রে আরণ্যক যশোরে অবস্থান করেছেন প্রায় একযুগ। অতি-কৈশোরেও তৎকালীন যশোরের উদ্ভিদজগৎ, সাধুসন্তদের চিন্তাধারা ও লালনগীতি তাঁর জীবনবোধকে স্পর্শ করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন তিনি। পেশাগত জীবনে মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদের বিজ্ঞান জাদুঘরে প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল কিউরেটর হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় দু-দশককাল। বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি দেশের প্রকৃতিকে গভীরভাবে অন্তরে ধারণ করে আছেন। ছুটিতে দেশে এসেই নিসর্গীদের নিয়ে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়ান বৃক্ষজগতের অলিগলিতে। বিদেশের খণ্ড-অবসরে তিনি রাইটার্স নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কয়েক বছর, বিজ্ঞান চর্চা করেছেন, গল্প-কবিতা লিখেছেন। প্রচারবিমুখ, বন্ধুবৎসল এই মানুষটির অনেক অদ্ভুত স্বভাব সম্পর্কে জানা যায়। দীর্ঘ যানজটেও কখনো ক্লান্ত হন না, চোখ তখন নিবিষ্ট থাকে রাস্তার পাশে বা সড়কদ্বীপের গাছগুলোর দিকে। প্রকাশনার পর কখনো নিজের বইয়ের খবর রাখেন না, মনে করেন পুস্তকের যাবতীয় অধিকার পাঠকের। খেয়ালি এই নিসর্গীর আরেকটি স্বভাব হলো উদ্ভিদসংক্রান্ত বিচিত্র তথ্য-সংগ্রহ করে তা অন্যদের অবহিত করা। জীবন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও উদ্ভিদের মেলবন্ধনে জায়েদ ফরিদের অবদান অনস্বীকার্য। এই সদালাপী, নিরহংকার মানুষটির পথচলা সরল ও নিরবচ্ছিন্ন হোক, আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।