বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস গৌরবময়; নানা মাত্রায় তা সমৃদ্ধ। সমসাময়িক কালেও সেই সমৃদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছেন কতিপয় গল্পকার। "ইসরাত জাহান" তাদেরই একজন। ছোটবেলা থেকেই আমরা গল্প শুনছি, পড়ছি। আমাদের শৈশব-কৈশোর বা বেড়ে ওঠার সময়গুলোও এক সময় গল্প হয়ে যায়। ফেলে আসা দিন বা সুদূর অতীতের দিকে তাকালেও সেই গল্পের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। যেন জীবনটাই একটি গল্প, একটি কাহিনি, একটি অঙ্কিত চিত্র। আর এই চিত্র নির্মাণের দিক থেকে "ইসরাত জাহান" যেমন অনন্য তেমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সহজ-সরল শব্দ বিন্যাসের মধ্যদিয়ে জীবনকে সাবলীলভাবে তুলে ধরেন। এই সাবলীলতা আবার বাক্য কিংবা বলার ঢংয়েও বিদ্যমান। স্বভাবগত দিক থেকে আত্মমুখী রোমান্টিক ভাবাবেশ থাকলেও কাহিনি বিন্যাসে আছে শৈল্পিক ছোঁয়া। ক্ষেত্রবিশেষে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল হলেও আঙ্গিকে ফুটে ওঠে তার সৌন্দর্যচারী মন-মনন। যেখানে আবহমান জীবনের আশা-আকাক্ষা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলোই মূল উপজীব্য। "মৃন্ময় জীবনের বিজন সন্ন্যাস" তার মন-মননেরই সমৃদ্ধ ফসল। নিজের জীবন দিয়ে অবলোকন করেছেন প্রকৃতি ও মানুষ। পেশাগত কাজের বদৌলতে সুযোগ ঘটেছে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখবার। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাই বর্নিত তার প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি শব্দে। "এই সর্ষের ক্ষেতে আমি ও আমার স্বামী কাজ কইরতি আইছি। সারাদিন ক্ষেতের দেখশোন করি। রাত জাইগি পাহারা দেই। সর্ষে ফুল থাইকি ফল হইবি। তারপর সেইগুলক টিনের ডেরামে বাইরে বাইরে সর্ষে বাইর কইরি এক্কেরে মহাজনের ঘরে তুইলে দিইয়ে তারপর ছুটি। আরো লোকজন আইছে, সবাই মিইলে মিইশে কাজ করি।" প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সরল জীবন-যাপন ঠিক এভাবেই তার গল্পে পুঙ্খানুপুঙ্খ উঠে আসে। জীবন ও প্রকৃতি নিবিড়ভাবে অবলোকন বা দেখার সূচাগ্র দৃষ্টি আছে তার। উদ্ধৃত একটি চরিত্রের কথাভঙ্গিই তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। আসলে তিনি গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজেকে মেলে ধরেন। তার কথাগুলোই যেন পাঠকের কথা। পঠন-পাঠনের মধ্যদিয়ে লেখক-পাঠক একাকার হয়ে যায়। সরল বর্ণনা, সাধারণ শব্দের ব্যবহার সাবলীল উপস্থাপনা খুব সহজেই পাঠককে আকৃষ্ঠ করে যা তার কর্মদক্ষতারই পরিচায়ক। জীবনে চলার পথে কত ঘটনা কত স্মৃতিইনা আমাদের স্পর্শ করে যায়। কিন্তু তাকে লিখিত মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য যে দীক্ষা প্রয়োজন এই গল্পকারের মধ্যে তা বিদ্যমান। তার গল্পগুলো যেমন সুখপাঠ্য তেমন আবেগ-অনুভূতির সুষম বিন্যাসে পরিপূর্ণ। ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে তিনি মূলত জীবনানুভূতিই প্রকাশ করেছেন। মানব-মানবীর প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাক্ষা তথা জীবনপ্রবাহের স্বরূপটিই এখানে প্রতীয়মান। প্রতিটি জীবনই একেকটি গল্প- সর্বজনবিদিত এ কথা মেনে নিয়েই গল্পকার পরিবেশন করেন ঘটনার পরম্পরা। যেখানে আপন মনের মাধুরীর সংযোগ থাকে, থাকে বিন্যাসগত প্রক্রিয়া যা পাঠক সাদরে গ্রহণ করেন। চেনা-পরিচিত ঘটনাবলীই যখন তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয় তখন মূলত তারা সেই বিন্যাসের সৌন্দর্যগত দিকটিকেই ধারণ করেন। গল্পকারেরও ইচ্ছে থাকে সেটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার। "কেমন করে পেলে আমাকে ? আমিতো কোথাও রাখিনি আমার চলার চিহ্ন । ভীষণ অভিমানে মনে হতো একজন মৃন্ময়ীর কোনো ঠিকানা নেই, কোনো স্বজন নেই, কোনো স্থায়ী শিকড় নেই।" জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুভূতিগুলো প্রকাশের এই রূপ ও রীতি যদিও আবহমান তবুও প্রায়োগিক দক্ষতায় তা পাঠক হৃদয়ে সূনিপুনভাবে গেঁথে যায়। পাঠক মূলত পাঠের মধ্যদিয়ে স্বাদ বা তৃপ্তিটুকু পেতে চান। "ইসরাত জাহান" তার সবটুকু দিয়েই পাঠককে নিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। সর্বমোট ষোলোটি গল্পের সমন্বয়ে এ গ্রন্থ। প্রতিটি গল্পেই তিনি তার উপলব্ধির ছাপ রেখেছেন, নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন জীবন ও প্রকৃতির রূপ-বৈচিত্র। আনন্দ-বেদনার সমন্বিত অনুভূতিতে সাজিয়ে তুলেছেন ঘটনাগুলো যা গল্পপ্রেমীদের পাঠতৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম।
ইসরাত জাহান। ঢাকাতেই বসবাস। পৈত্রিক বাড়ি পাবনা জেলার ইশ্বরদী থানার পাকশীতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে। লেখালেখির শুরু ছোটবেলা থেকেই। লিখেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অন্যান্য মাধ্যমে। প্রকাশিত হয়েছে চারটি একক কাব্যগ্রন্থ (তোমার কাছেই ফেরা, আমার আছ তুমি, ভাঙা চশমায় ভাঙলো মন এবং নির্জনে)। 'নির্জনে' তাঁকে এনে দেয় আলাদা পরিচিতি। " মৃন্ময় জীবনের বিজন সন্ন্যাস" তাঁর পঞ্চম বই হলেও প্রথম গল্পগ্রন্থ। তিনি বিশ্বাস করেন, ভালোবাসার উল্টো দিকে ভালোবাসাই থাকে।