খাজা আহমদ আব্বাস ১৯১৪ সালে অবিভক্ত পাঞ্জাবের পানিপাতে (বর্তমানে হরিয়ানার অন্তর্ভুক্ত) জন্মগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত উর্দু কবি, সমাজসংস্কারক ও ভারতের প্রথম নারীবাদী কবি আলতাফ হোসেন ছিলেন তাঁর নানা এবং তাঁর দাদা ছিলেন ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম খাজা গোলাম আব্বাস। বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরেজরা তাঁকে গ্রেফতার করে কামানের মুখে বেঁধে গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তাঁর পিতা খাজা গোলাম-উস-সিবতাইন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েটদের একজন ছিলেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে খাজা আহমদ আব্বাস আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩৩ সালে ইংরেজিতে ও ১৯৩৫ সালে আইনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ‘দ্য বোম্বে ক্রনিকল’-এ যোগদানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি সেখানে ‘লাস্ট পেজ’ নামে একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখতেন, যা তিনি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র ‘ব্লিটজ’-এ যোগ দেওয়ার পরও একই শিরোনামে লিখতেন এবং ১৯৮৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কলামটি লিখেছেন। তাঁর কলামটিকে ভারতে দীর্ঘ সময় যাবৎ লেখার ক্ষেত্রে রেকর্ড বলে বর্ণনা করা হয়। একজন রিপোর্টার হিসেবে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কাছে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল প্রায় অবাধ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে বিচরণ শুরু করেন চল্লিশের দশকের শুরুতে। প্রথমে তিনি কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার কাজে জড়িত হলেও পরবর্তীতে ছায়াছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা শুরু করেন। তাঁর নির্মিত ছায়াছবি চারবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে এবং তাঁর ছায়াছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করে। পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে খাজা আহমদ আব্বাস আধুনিক বাস্তবসম্মত সিনেমার অগ্রদূত হিসেবে গণ্য এবং একজন চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসেবে তিনি রাজ কাপুরের সেরা ছায়াছবিগুলোর কাহিনি ও চিত্রনাট্যের রচয়িতা ছিলেন। তাঁর পরিচালিত ছায়াছবিগুলো হচ্ছে : ‘সাত হিন্দুস্তানি’, ‘ধরতি কে লাল’, ‘আনহোনি’, ‘রাহী’, ‘মুন্না’, ‘চার দিল দো রাহে’, ‘ঈদ মোবারক’, ‘গ্যায়ারাহ হাজার লাড়কিয়া’, ‘শেহের আউর সপনা’, ‘হামারা ঘর’, ‘আসমান মহল’, ‘বোম্বাই: রাত কি বাহো মেঁ’, ‘দো বুন্দ পানি’, ‘লব কুশ’, ‘ফাসলাহ’, ‘দ্য নক্সালাইটস’, ‘মি: এক্স ইন বোম্বে’ ও ‘এক আদমি’। উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, ভ্রমণকাহিনি, ছোটগল্প সংকলন এবং বিভিন্ন বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ সংকলনসহ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭৪-এর অধিক। খাজা আহমদ আব্বাসের আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড’ তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং এতে উঠে এসেছে তাঁর শৈশব, আলীগড়ের জীবন, ভারত-বিভাগ এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্যময় জগতে তাঁর বিচরণের সৎ, বস্তুনিষ্ঠ সাবলীল বিবরণ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ইনকিলাব’ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্ট, খ্যাতনামা ব্রিটিশ কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন, চীনের মাও জে দং, নভোচারী ইউরি গ্যাগারিনসহ বহু আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। খাজা আহমদ আব্বাস এমন একজন আশাবাদী ব্যক্তি ছিলেন যিনি সাধারণ মানুষের মাঝে আকাক্সক্ষা দেখতেন। তাঁর কলাম, ছোটগল্প ও উপন্যাস এবং তাঁর নির্মিত ছায়াছবিতে তিনি সাধারণ মানুষের দুর্দশা ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি তাদের স্বপ্নগুলোও তুলে ধরতেন। তিনি কখনো তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে আপস করেননি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘আমি যা কিছু প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করেছি এবং যে অভিজ্ঞতা অর্জন ও অনুভব করেছি, সবই করেছি আমার ভেতর থেকে। কারণ, সবই আমার অংশ এবং আমি সবকিছুর অংশ। পৃথিবী আমাকে সৃষ্টি করেছে এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অণু পরিমাণ হলেও আমি পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছি। আমি মানবতার সঙ্গে যুক্ত, যেভাবে মানবতাও আমার সঙ্গে যুক্ত। গাছ যেমন বীজের জন্ম দেয়, একইভাবে বীজ থেকেই গাছের জন্ম হয়।’ তিনি সবসময় তাঁর সাহিত্যকর্মের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি তাঁর অন্তিম ইচ্ছায় বলেন, ‘আমি চলে যাওয়ার পর যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, তারা শুধু আমার লেখা সত্তরটির বেশি বইয়ের মধ্য থেকে একটি তুলে নিন অথবা আমি যে ছায়াছবিগুলো প্রযোজনা করেছি অথবা যেগুলোর স্ক্রিপ্ট লিখেছি, সেগুলো দেখুন। হলদে হয়ে যাওয়া নিউজপ্রিন্টে আপনাদের যদি অ্যালার্জি না থাকে, তাহলে লাইব্রেরিতে গিয়ে আমার লেখা হাজার হাজার কলামের একটি পাঠ করুন। সেখানে আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব।’ ১৯৮৭ সালে ১ জুন অসাধারণ সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব খাজা আহমদ আব্বাস মৃত্যুবরণ করেন।