২০০৭ সনের ২৮ জানুয়ারী ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার জন্য নির্ধারিত ছিল। মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিনে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ জোট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে দেশে একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দেশে এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান হলে জাতিসংঘ থেকে, আমাদের শান্তিরক্ষা বাহিনী ফেরত পাঠানো হবে। এ রকমের অজুহাত সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীর প্রধান মইন উদ্দিন আহম্মদ প্রেসিডেন্টকে ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে দেশে জরুরী আইন ঘোষণা করতে বাধ্য করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি তত্ত্বাবধায়ক নামে একটি জরুরী সরকার গঠন করা হয়। সেনাসমর্থিত এই জরুরী সরকার রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দুই নেত্রীকে “মাইনাস টু” এবং দেশকে বিরাজনীতিকরণের এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে প্রথমে দুইটি বড় দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক দূর্নীতির অভিযোগ এনে গ্রেফতার শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কিছু ব্যবসায়ীকেও গ্রেফতার করে নির্যাতন চালায়। অবশেষ দুই নেত্রীকেও গ্রেফতার করা হয়। যৌথ বাহিনী সৃষ্টি করে চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। এমনি এক পর্যায়ে ৭ মার্চ, ২০০৭ তারিখে যৌথ বাহিনী আমাকে নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর আমার বিরুদ্ধে এলাকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিকে দিয়ে ৪টি চাঁদাবাজি মামলা করা হয়। যৌথ বাহিনীর প্ররোচণায় দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ২টি মামলা দায়ের করে এবং পরিবারের উপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। গ্রেফতারের সময় আমার সাথে যৌথ বাহিনীর আচরণ, দীর্ঘ ৬১৬ দিন কারাবরণের অভিজ্ঞতা এবং জরুরী সরকারের কর্মকান্ডকে কারাগার থেকে আমি যে ভাবে মূল্যায়ন করেছি তার ধারাবাহিক বিবরণ এই পুস্তকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কিভাবে রাজনীতিবিদরা লাঞ্ছিত হন, তাদের কিভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাজনীতি করতে হয় এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিগতভাবে কি পরিমাণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়, তা এই পুস্তকখানা পাঠ করলে সামান্য হলেও উপলব্ধি করা যাবে। তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতি যে একটা ধন্যবাদ বিবর্জিত কাজ, তা পুস্তকের বিষয়বস্তু থেকে পরিস্ফুটিত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । রাজনৈতিক নেতারা কারাগারে যান। সেখানে কিছু অভিজ্ঞতা এবং চেতনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু জেল মুক্তির পর সব ভুলে গিয়ে আবার সনাতন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে জরুরী সরকারের সময়ে রাজনীতিবিদদের কি অবস্থা ছিল এবং তাদের সেই সময়কার অনুভূতিকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এই পুস্তক সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে রাজনীতিবিদদের মুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৯৪৬ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ব বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেমায় যোগদান করেন। একই বছর ‘কলম্বো প্লান স্কলারশীপ’ লাভ করে উচ্চ শিক্সার জন্য লন্ডন গমন করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে তিনি ১৯৭০ সালে এমএসসি, ১৯৭৩ সালে ডিআইসি এবং ১৯৭৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভ করে ১৯৭৫ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক, ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক এবং ১৯৮৭-১৯৯০ মেয়াদে ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন শিক্ষাজীবনে ছাত্র-রাজনীতিতে সত্রিয় ছিলেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রসংসদের নির্বাচিত এজিএস এবং হাজী মোহাম্মদ হমসিন হল ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বয়াক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৯৭৯ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে এবং তাঁর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হন এবং অদ্যাবধি এই পদে বহাল আছেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সাথে বিভিন্ন সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, স্বরাষ্ট্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জেনেভায় অনুষ্ঠিত ২০০৩ সালে ৫৬ তম বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ২০০৪ সালে বিশ্বব্যাপী তামাক বিরোধী আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকার জন্য ৫৬ তম বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনে তাঁকে `World No Tobacco Award’ এ ভূষিত করা হয়। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেশ ও বিদেশের বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ভূতত্ত্ব ভিষয়ে তাঁর একটি মৌলিক উদ্ভাবন `Hossain’s Method of Extension’ নামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক।