বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস অনেক সময় ১৯৭১ কেন্দ্রিক করে ফেলা হয়। কিন্তু এদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের ধারাটি দীর্ঘকালের স্মৃতিবাহী। বাঙালি বরাবরই স্বাধীনচেতা একটি জাতি। এ জাতির পূর্বপুরুষদের শরীরেও এ তেজ নিহিত ছিল। প্রাচীনকালে আর্যরা বাংলায় ঢুকতে পারেনি। মহাবীর আলেকজান্ডার বাঙালির শৌর্য-বীর্যের খবর জেনেছিলেন, তাই আর বাংলামুখী না হয়ে নিজদেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আর বাংলার ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই শ্রেণি-সংগ্রামের একটি ধারা সততই বিদ্যমান ছিল। বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ তাই বাঙালির সহজাত একটি বৈশিষ্ট্য, যা বছরের পর বছর ধরে চলে এসেছে। এ ধারাই ১৯৭১ সালে পরিপুষ্ট হয়েছে, যদিও বিদেশি শক্তির শাসন ও শোষণ দীর্ঘদিন ধরে বাংলার মানুষকে পিষ্ট করে রেখেছিল, তথাপি ইতিহাসের সূত্রগুলো বলে, বাঙালি কখনোই এসব মেনে নেয়নি। প্রাচীন আমলেই এদেশে আরব বণিক মুসলিমরা এসেছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে এদেশীয়দের দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়নি। কারণ, আরবরা এসেছিল শুধু ধর্মপ্রচার করতে। রাষ্ট্রশাসন ও প্রশাসনে তারা আগ্রহ দেখায়নি। এর পরের মুসলিম শক্তি হিসেবে বাংলায় আগমন করে তুর্কিরা, কিন্তু তুর্কিদের শাসনে ধর্মপ্রচার ছিল না, ছিল শাসন ও ক্ষমতার লিপ্সা। অথচ আরব মুসলিমদের প্রভাব বাংলার সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটায়, যা তুর্কি শাসনে ঘটেনি। মোগল, পাঠান এবং অন্যান্য মুসলিম শক্তিরও উত্থান ঘটেছিল উপমহাদেশে। যাদের মূল লক্ষ্য ছিল শাসনক্ষমতা। যদিও তারা এদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, তথাপি ইসলাম প্রচারে তাদের বিশেষ ভূমিকা দেখা যায় না, বরং মোগল সম্রাট আকবর তো ছিলেন ইসলামবিরোধী শক্তির এক প্রতিনায়ক। আকবরের আমলেও বাংলায় বিদ্রোহ ও স্বাধীনচেতার ধারা অব্যাহত ছিল। এদেশে লুটেরা ভূমিকায় এসেছিল ইংরেজের ছদ্মাবরণে খ্রিস্টশক্তি। সত্যেন সেন তাঁর মসলার যুদ্ধ এবং সুরঞ্জিং দাশগুপ্ত ভারতবর্ষে ইসলাম গ্রন্থে এ শক্তির লুটেরা-চরিত্র উদ্ঘাটন করেছেন। ১৭৫৭ সালে এ শক্তি যেভাবে উপমহাদেশের শাসনদণ্ড হাতে তুলে নেয়, তা ছিল অনৈতিক এবং বর্বরতায় পূর্ণ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের কূটকৌশলেও তাদের এ মুসলিমবিরোধী চতুরতা ধরা পড়ে। ১৯৪৭ সালেই ‘বাংলায়’ একটি আলাদা স্বাধীন দেশ হতে পারত, কিন্তু ভারতের হিন্দু এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা তা হতে দেয়নি। ফলে স্বাধীন একটি দেশের জন্য বাঙালিদের আরও বিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এ বিশ বছরে বাঙালি পেয়ে যায় তাদের অমিততেজ-সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ফলে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ যুদ্ধ ছিল অস্ত্রের দিক থেকে অসম। কিন্তু তেজ, স্পৃহার দিক থেকে বাঙালিরা ছিল মরণপণ করা এক শক্তি। আর ৩০ লাখ বাঙালিকে শহিদ হতে হয় মুক্তিসংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ক্ষণে।
ড. মােহাম্মদ হাননান সহস্রাব্দ ও শতাব্দীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইত্যাদির ওপর যে। সংগ্রহ-সংকলনটি করেছেন তা অনুসন্ধিৎসু যে-কোনাে পাঠকের কাছেই বিশ্বকোষের স্বাদ এনে দেবে। শতাব্দীর বাংলাদেশ, শতাব্দীর বিশ্ব, সহস্রাব্দের বাংলাদেশ, সহস্রাব্দের বিশ— গ্রন্থ চারটিকে নানাভাবেই সাজানাে যায়। এখানে পাঠক বাংলাদেশকে পাবেন দু’ভাবে-শতাব্দী ও সহস্রাব্দের মতাে করে, আবার বিশ্বকেও পাবেন শতাব্দীর পাশাপাশি সহস্রাব্দের পটভূমিতে। শতবছর অথবা হাজার। বছরের পরিক্রমায় বাংলাসমাজ ও বিশ্বসমাজ এভাবেই গ্রন্থ চারটিতে মূল্যায়িত হয়েছে।