একুশ শতকের ভোরে বাংলাদেশের ছোটগল্পের মহোৎসবে কথাশিল্পী জায়েদ ফরিদ তাঁর গল্পসম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছেন। পাঠের পর তাঁর প্রতিটি গল্প নতুননিত্যনতুন তরতাজা শিল্পসুষুমায় প্রজাপতির পাখায় পাখায় উড়ে বেড়ায় পাঠকমনে মহাপ্রকৃতিরই একটি অংশ মানব-মানবীর মানসপ্রকৃতির নিটোল দ্বৈরথ-আঁকা ভাষার আঁচড়ে রচিত একেকটি গল্প । রঙচঙা কাপড় দেখলে রেলিঙয়ে বসা গাঙচিলেরা উড়ে যেতে চায়—গঙ্গামণি ময়লাটে একটা শাদা রঙের কাপড় পরেই বের হয়, বালুচরের শাদা রঙেই ওরা বেশি অভ্যন্ত। গাঙচিলগুলি রেলিঙয়ে নদীর দিকে মুখ করেই বসে ছিলো— গঙ্গামণি বের হবার পর তার দিকে মুখ করে বসে। সে দুখানি বাসি রুটি নিয়ে যায় সঙ্গে । দুয়েকটা গাঙচিল গঙ্গামণির কাঁধে এসে বসে। তাজা মাছ খাওয়া তাদের অভ্যাস, ক্ষুধার্ত না-থাকলে রুটির টুকরা মুখে তুলতে চায় না। এ গল্প এমন এক মানবীর গল্প যে মানবী হয়েও গাঙচিলদের অবিস্মরণীয় মা। *গাঙচিলের ডিম' গল্পগ্রন্থের ঝুড়িতে আরও আছে বাংলা ছোটগল্পের তপ্ত ভাণ্ডারের ডজনখানেক গল্প। প্রতিটি গল্পের বাস্তবতা ও শিল্প-বাস্তবতা এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ যে পাঠককে তা অবিচ্ছেদ্য হৃদ্যতায় আলিঙ্গন করে। আধুনিক ছোটগল্পের ভুবনে নতুনতর স্বাদের গল্প নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন জায়েদ ফরিদ। আবহমান বাঙলার গ্রামজীবন থেকে নগর, এমনকি সুদূর মরুভূদেশের পটভূমিকায় বেদুঈন মাজরাতেও পাঠককে অভিভূত করেন তিনি।
জন্ম ১৯৪৮ সালে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে এক বিমিশ্র প্রাকৃতিক ঠিকানায় যার সামনে পদ্মা, পেছনে যমুনা, মাঝখানে কাশবন, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এবং বন-জঙ্গল। গাঙ্গেয় শুশুকের সঙ্গে সাঁতার কেটে আর বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বড় হয়েছেন তিনি। শৈশবের দুরন্ত জায়েদের প্রথমপাঠ পাবনায় শুরু হলেও পরবর্তীকালে পিতার চাকরিসূত্রে আরণ্যক যশোরে অবস্থান করেছেন প্রায় একযুগ। অতি-কৈশোরেও তৎকালীন যশোরের উদ্ভিদজগৎ, সাধুসন্তদের চিন্তাধারা ও লালনগীতি তাঁর জীবনবোধকে স্পর্শ করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন তিনি। পেশাগত জীবনে মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদের বিজ্ঞান জাদুঘরে প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল কিউরেটর হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় দু-দশককাল। বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি দেশের প্রকৃতিকে গভীরভাবে অন্তরে ধারণ করে আছেন। ছুটিতে দেশে এসেই নিসর্গীদের নিয়ে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়ান বৃক্ষজগতের অলিগলিতে। বিদেশের খণ্ড-অবসরে তিনি রাইটার্স নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কয়েক বছর, বিজ্ঞান চর্চা করেছেন, গল্প-কবিতা লিখেছেন। প্রচারবিমুখ, বন্ধুবৎসল এই মানুষটির অনেক অদ্ভুত স্বভাব সম্পর্কে জানা যায়। দীর্ঘ যানজটেও কখনো ক্লান্ত হন না, চোখ তখন নিবিষ্ট থাকে রাস্তার পাশে বা সড়কদ্বীপের গাছগুলোর দিকে। প্রকাশনার পর কখনো নিজের বইয়ের খবর রাখেন না, মনে করেন পুস্তকের যাবতীয় অধিকার পাঠকের। খেয়ালি এই নিসর্গীর আরেকটি স্বভাব হলো উদ্ভিদসংক্রান্ত বিচিত্র তথ্য-সংগ্রহ করে তা অন্যদের অবহিত করা। জীবন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও উদ্ভিদের মেলবন্ধনে জায়েদ ফরিদের অবদান অনস্বীকার্য। এই সদালাপী, নিরহংকার মানুষটির পথচলা সরল ও নিরবচ্ছিন্ন হোক, আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।