বার্ট্রান্ড রাসেল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি' নামক একই পুস্তকটি রচনা করেছিলেন ১৯৩১ সালে তা ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কাল। পৃথিবী তখন যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইতোমধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল, তা যে মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করেনি, বরং তার ধ্বংসস্পৃহাকে উপ্ত করে রেখেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই তার প্রমাণ। কিন্তু এরই মধ্যে বিবেকবান, প্রগতিশীল, শাস্তিবাদী মানুষদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রসার ঘটেছিল; সেই দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ঘটেছিল গ্যালিলিও-এর মাধ্যমে এবং তারপর কেপলার, নিউটন, ডারউইন, আইনস্টাইন, পাভলভের মতো বড় একদল বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার ও দর্শনের মধ্য দিয়ে সেই মনোভাব মূর্ত রূপ পেয়েছিল। রাসেল ছিলেন সেই মনোভাবের এক মূল প্রবক্তা। তিনি বলেছেন "বিজ্ঞান নামটি যা বুঝায় তা প্রাথমিকভাবে হলো জ্ঞান; প্রথাগতভাবে তা নির্দিষ্ট কিছু ধরনের জ্ঞান; নামত তা হলো সুনির্দিষ্ট কিছু ফ্যাক্টের সঙ্গে সম্পর্কিত করে সাধারণ সূত্রের অনুসন্ধান। কিন্তু সেই জ্ঞান যে মানুষকে শাস্তি ও সুখের কাছে নিয়ে যায় না, তার কথা বলেন রাসেল। তিনি তাই বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রজ্ঞার যোগের কথা বলেন। রাসেল তাঁর বিভিন্ন রচনা—এই বইটিতেও—যৌক্তিক, তথা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন অন্তিম বিশ্লেষণে তা দাঁড়ায় জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গি। এই পুস্তকটিকে রাসেল আমাদেরকে সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিশা দেন, কিন্তু আমাদেরকে আরও এগিয়ে যেতে বলেন। 'একটি বৈজ্ঞানিক সভ্যতাকে যদি উত্তম সভ্যতা হয়ে উঠতে হয় তাহলে জ্ঞানের বৃদ্ধিকে প্রজ্ঞার বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। প্রজ্ঞা বলতে জীবনের লক্ষ্যের সঠিক ধারণা বুঝায়। এটি এমন কিছু যা খোদ বিজ্ঞান প্রদান করে না। ফলে, বিজ্ঞান যদিও প্রগতির প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে তবুও খোদ বিজ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভেজাল প্রগতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এমনই ঘটছে বৈজ্ঞানিক পৃথিবীতে। তাই আমাদেরকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে প্রজ্ঞাময় জীবন অনুসরণ করতে হবে, এমন 'বাণীই' এই পুস্তকটির মূল বক্তব্য ।
(১৮ মে ১৮৭২ – ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০) ছিলেন একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী, এবং সমাজ সমালোচক.যদিও তিনি ইংল্যান্ডেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, তার জন্ম হয়েছিল ওয়েলস এ, এবং সেখানেই তিনি ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসেল ১৯০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশদের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়, এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তার শিষ্য ভিটগেনস্টেইন এবং পূর্বসূরি ফ্রেগে এবং তাকে ২০ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম যুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাসেল এবং হোয়াইটহেড একত্রে প্রিন্কিপিয়া ম্যাথমেটিকা নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা গণিতকে যুক্তির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তার দার্শনিক নিবন্ধ "অন ডিনোটিং" দর্শনশাস্ত্রে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। দুটো গ্রন্থই যুক্তি, গণিত, সেট তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং জাতিসমূহের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। রাসেল তার অহিংস মতবাদ প্রচারের জন্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলবন্দী হন, তিনি হিটলারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান, সোভিয়েত টোটালিটারিয়ানিজম এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের সমালোচনা করেন এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। রাসেল ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন, যা ছিল "তার বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ যেখানে তিনি মানবতার আদর্শ ও চিন্তার মুক্তিকে ওপরে তুলে ধরেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিরোধীর ভূমিকা নেন, ফলস্বরূপ তাঁকে ছ'মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। সেই সঙ্গে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক পদ থেকে বরখাস্ত হন। ১৯৫০ সালে পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই কারণে ১৯৬১ সালে তাঁকে আবার কারাদনণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৭০ সালে বারট্রান্ড রাসেল মৃত্যুবরণ করেন।