প্রাককথন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত হওয়া ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী’তে উনিশ হাজার গেরিলা যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এরা দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে গিয়ে নানাভাবে ভ‚মিকা পালন করেন। এরা সকলে ছিলেন গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কেউ অংশ নেন সম্মুখযুদ্ধে, কেউ নানা জরুরি তথ্য আদান-প্রদান, ওষুধ, বস্ত্র সংগ্রহ ও পৌঁছে দেওয়া, কেউ বা চিকিৎসা দেন আহত সহযোদ্ধাকে। আমার শ্বশুর আবদুল হালিমও ছিলেন এই বাহিনীর একজন সদস্য। তিনি ফেনী জেলার দাগনভ‚ঞা উপজেলার রাজাপুর, জয়নারায়ণপুর, পূর্ব জয়নারায়ণপুর, দীঘির জান, দুই সতীনের দীঘি, কোরাইশমুন্সী, ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। আবদুল হালিম দাগনভ‚ঞার রাজাপুরে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে চরম নির্যাতনের শিকার হন। সেখানে পুরাতন বোর্ড অফিসের ( ইউনিয়ন পরিষদ ভবন) পেছনে নদীর পাড়ে গাছের সাথে বেঁধে গুলি চালায় রাজাকাররা। তার চোখের সামনে গুলি খেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রাণ হারান সহযোদ্ধা, মাথিয়ারা এলাকার আলী আরশাদ। আবদুল হালিমকে পিঠে গুলি করা হয়। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে গুলি তার পিঠের চামড়া ভেদ করে মেরুদÐ স্পর্শ করে একপাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। অতিকষ্টে প্রাণে রক্ষা পান তিনি। এ বইয়ে সেই সময়ের এইসব দুঃসহ ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নানা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমরা কথা বলেছি তখনকার বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধার সাথে। অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের অনেকেই অর্ধশত বছরের পুরনো তথ্যগুলো পুরোপুরি জানাতে পারেননি। তবু যেটুকু তথ্য আমরা পেয়েছি তার আলোকে এ বইটি রচিত হয়েছে। আমরা কথা বলি বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর হোসেন মীরু স্যার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের, বিশিষ্ট মৎস্য খামারি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব সাজু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক জাহিদ হোসেন বাবলু, রাজাপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম পাটোয়ারী, জয়নারায়ণপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের খান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মহসীনের সাথে। এ ছাড়া যে স্থানে তাদের গুলি করা হয় তার পাশের রাজাপুর মৃধাবাড়ির বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন (৮০) ও পার্শ্ববর্তী হাজী ওসমান আলী ভ‚ঞাবাড়ির জাহেদা খাতুনের (৭০) কাছ থেকেও আমরা ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা সংগ্রহ করি। এদের সবার কাছে আমি পরিবারের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই বইয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির সাথে মিল রেখে বেশ কিছু ছবিও ব্যবহার করা হয়। এসব ছবির মাধ্যমে প্রিয় পাঠকগণ ওই সময়ের একটি চিত্র খুঁজে পাবেন বলে মনে করি। বিভিন্ন সময়ে দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’, ফেনীর দৈনিক ‘অজেয় বাংলা’, সাপ্তাহিক ‘হকার্স’ ও সাপ্তাহিক ‘কলকণ্ঠে’ আবদুল হালিমকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু পুরনো বসতঘর থেকে নতুন ঘরে স্থানান্তরকালে অনেকগুলো প্রতিবেদন হারিয়ে যায়। শুধু সাংবাদিক সৌরভ পাটোয়ারির লেখা একটি প্রধান প্রতিবেদন, যা সপ্তাহিক ‘কলকণ্ঠে’ ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, তা এখানে তুলে ধরা হলো। আমি প্রতিবেদনটি রচনার জন্য সৌরভ পাটোয়ারি এবং এটি প্রকাশের জন্য সম্পাদক শহীদুল আলম ইমরান ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই।