ফ্ল্যাপে লিখা কথা বিশ শতকের প্রথমার্ধে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী যে পরিবর্তন সূচিত হলো, তার অভিঘাত ভারতবর্ষকেও স্পর্শ করলো। এই দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন বিনষ্ট সময়ের পোড়োজমিতে বিস্ময়কর ভাবে ফুটেছিলো কবিতার উজ্জবল প্রসূন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা কবিতার জগতে যে পাকা আসনটি অধিকার করেছিলেন তার অংশীদার হয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আর্বিভাব এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
দুই বাংলার মিলিত জাতিসত্তার কবি- কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বাংলা কবিতায় এনেছিলেন সাম্যবাদের সুর, প্রচার করেছিলেন সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বাণী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচলিত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বদল ঘটিয়ে তার জায়গায় সাধারণ মানুষের জয়গান করেছিলেন, দীর্ঘকালের নিপীড়িত শোষিত অগণিত কৃষক শ্রমিকের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে তারেদ আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তাঁর কলমের মুখে ভাষা জুগিয়েছিলেন।
নজরুল স্বভাবকবি ছিলেন নিশ্চয়ই কিন্তু তাঁর সেই স্বভাব- কবিত্বকে অনুশীলন-পরিশীলনের বুদ্ধিসম্মত পথে যথোচিত পরিমাণে উজ্জ্বল করে তোলার কৃতিত্ব গৌরবও তাঁর।
তিনি বিদ্রোহী কবি। মানবপ্রেমিক কবি। তাঁর বিদ্রোহ আর মানবপ্রেম অভিন্ন; একই উৎস থেকে এই দুয়ের উদ্ভব। তাঁর প্রেমিক-সত্তাই তাঁকে বিদ্রোহীতে রূপান্তরিত করেছিল। বাংলা কাব্যের আকাশে নজরুলের আবির্ভাব যথার্থই একই ধূমকেতুর মত, যে-দূমকেতু তার পু্ছতাড়নায় পুরনো অনেককিছু জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে উদ্যত।
সৃষ্টিশীল প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের মত তাঁর আর একটি গণনীয় দিক তাঁর সঙ্গীত। সৃষ্টি প্রাচুর্যের সে এক অবারিত বন্যা-প্রবাহ। সাম্যবাদী এ কবির গানের জগৎ এক বিচিত্র জগৎ। এই জগৎ সৃষ্টির প্রাচুর্যে, সুরসৃষ্টির উল্লাসে, বিভিন্ন শ্রেণীর গানের রচনায়, সুরের মাদকতায়।
নজরুল জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে কাব্যসাধনা ও সংগীত সাধনা ছিল অবিচ্ছিন্ন। তাঁর কাব্য ও সংগীত এক আধারে এসে মিশে গিয়েছিল কখনও সমান্তরাল প্রবাহে, কখনও যুগ্ম ধারায়। বাংলা সাহিত্যে এমনতর যুগ্ম সাধনার সার্থকতার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দু’জন- একজন নজরুল স্বয়ৎ অপর জন রবীন্দ্রনাথ।
এবইটিতে কবি নজরুল সকল কাব্য গ্রন্থ থেকে প্রধান কবিতাসমূহ এবং তার রচিত সকল শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য, স্মরণীয় ও কালজয়ী গান সংকলিত হয়েছে।
নজরুলের এত সৃষ্টিরাজির বিদর্শন একসাথে দেখে আপনি বিস্মিত হবেন নিঃসন্দেহে।
তাঁর অফুরান সৃষ্টি-প্রাচুর্য, তাঁর নিত্যনব নবোন্মোষশীল সৃষ্টিকল্পনার ঐশ্বর্য, তাঁর লেখনীর সাবলীলতা স্বতঃস্ফূর্তিতা সেই সঙ্গে তাঁর কল্পনার সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য আপনাকে করবে অভিভূত, বিমোহিত। তাঁর অসামান্য সহজাত বা অদৃশ্য প্রেণাসঞ্চালিত দৈবানুগ্রহ পুষ্ট অথবা দু’য়ের সমন্বিত প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে তাঁর অবারিত অবিশ্রাম অনর্গল ধারায় উচ্ছসিত সৃষ্টি প্রবাহের স্রোতধারার ভেতর দিয়ে। এ সহেলী, সংরাগময়, সন্ধিগ্ন সৃষ্টিশীল স্রোতধারায় যে কোন বাংলাভাষী পাঠক পুনঃপুনঃ স্নান করে নতুনোদ্যমে পা বাড়াতে পারেন স্বীয় সৃষ্টিশীল পথে বা মননবিকাশশীল অথবা প্রজ্ঞার পেলব পথে।
বাংলা বিদ্রোহী, প্রেমিক ও জাতীয় কবিকে একসাথে পড়তে পারার উল্লেশ্যেই আমাদের এই আয়োজন। নজরুলপ্রেমি যে কোন বয়েসী, মেধার পাঠকের জন্যতো বটেই বিভিন্ন শিক্ষা ও শিক্ষান্নোয়নমূলক পাঠাগারে অন্তর্ভূক্তির জন্য একটি আবশ্যিক গ্রন্থ, কেননা যে ক’জন কবিকে বাদ দিয়ে বাংলা কবিতার কথা ভাবাই যায়না তার মধ্যে নিঃসন্দেহে নজরুল অনন্য, অসাধারণ এবং মৌলিক খাদ্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।