তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী কল্পনা! কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত একদা যাহাকে ‘দেবি’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন মোহন রায়হান তাঁহার কৃপালাভ করিয়াছেন- এতদিন এ সত্যে সন্দেহ ছিল না। ‘কবিতা ও জীবন’ গ্রন্থে গদ্যের কড়া হাতুড়ি তুলিয়া লইবার পর স্বীকার করিতে হইবে তিনি অন্যদেবেরও প্রীতিধন্য হইলেন। ‘কবিতা ও জীবন’ নিছক কবিতা ব্যবসায়ীর স্মৃতিকথা নয়, ১৯৭১ পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের গদ্য-পদ্য আন্দোলনের সামাজিক ইতিহাস বটে। এই সামাজিক-ঐতিহাসিক বয়ান যোগে মোহন রায়হান বিগত অর্ধশতাব্দীর একটা বাণীচিত্র আঁকিয়াছেন। এই চিত্র যেমন আশার তেমন আশাভঙ্গের, যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামের তেমন পরাধীনতাবরণের ইতিবৃত্ত। সুখের মধ্যে শুদ্ধমাত্র নৈরাশ্যের নয়, নতুন জীবনে উত্তরণের হাতছানিও ইহার ছায়ায় পাওয়া যাইবে । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একদিন লিখিয়াছিলেন, ‘কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ। কবিতা দর্পণ মাত্র-তাহার ভিতর কবির অবিকল ছায়া আছে। দর্পণ বুঝিয়া কি হইবে? ভিতরে যাহার ছায়া, ছায়া দেখিয়া তাহাকে বুঝিব। কবিতা, কবির কীর্ত্তিÑতাহা ত আমাদের হাতেই আছেÑ পড়িলেই বুঝিব। কিন্তু যিনি এই কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন, তিনি কি গুণে, কি প্রকারে, এই কীর্ত্তি রাখিয়া গেলেন, তাহাই বুঝিতে হইবে।’ এই গ্রন্থের পাঠক-পাঠিকা আশা করি বঙ্কিম-কথিত সেই গুরুতর লাভের বখরা পাইবেন। সেই বখরা কি পদার্থ তাহার বিবরণ দিয়াছেন আহমদ ছফা। আমি হই তেমন এক মন্দভাগ্য লোক শিরোপা সম্মান আর উচ্চতর মহত্ত¡গৌরব যার হৃদয়ধর্মের কাছে মানে পরাভব। সলিমুল্লাহ খান
মােহন রায়হান। বাবা ফরহাদ হােসেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আজাদ হিন্দ । ফৌজ’-এর সৈনিক ছিলেন। মা মাহমুদা খাতুন। সমাজসেবী। ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে জন্ম। ১৯৮০-৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। দ্রোহ-প্রতিবাদ, লড়াই-চেতনা, প্রেম-প্রকৃতি ও জীবনের গভীরতম অনুভূতির কবি। সমাজ বদলের আপসহীন সৈনিক বলিষ্ঠ সংগঠক। প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, বাংলাদেশ লেখক শিবির, আবৃত্তি সংসদ, অরণি, রাখাল, বাংলাদেশ । ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর সাবেক সংগঠক ও নেতা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অগ্নিঝরা একাত্তরে সিরাজগঞ্জে স্থাপিত ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর কবি। কবিতাপত্র দিকচিহ্ন ও “সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন'-এর সম্পাদক। বাংলাদেশে বিনা অপারেশনে ‘হৃদরােগ থেকে মুক্তি এবং “বিনা তেলে রান্না আন্দোলনের পথিকৃৎ। সাওল হার্ট সেন্টার (বি.ডি.) লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মােহন রায়হান স্বৈরাচার ও সামরিক দুঃশাসনের শেকড় উপড়াতে বারবার জেল-জুলুম নির্যাতন সয়েছেন, দাঁড়িয়েছেন সামরিক আদালতের কাঠগড়ায়। তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান প্রভৃতি দেশে কবিতাপাঠ ও রাজনৈতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।