গোলাপজাম বনে একটি দুষ্ট বাদুড় আর একটি দুষ্ট ইঁদুর বাস করে। তারা দুজন আবার বন্ধু। বাইরের পাখিদের গোলাপজাম বনে পুরো মাস অবস্থান করে গোলাপজাম খাওয়াকে তারা পছন্দ করল না। বৈশাখের পরে পাখিরা যখন ফিরে গেল তখন সহজ-সরল কাঠঠোকরা ও মোচাটুনিকে তারা পাকড়াও করে বনের দক্ষিণের প্রাচীন বটগাছের নিচে লোহার একটি খাঁচায় বন্দি করল। অনেক আগে এক সাধু লোহার খাঁচাটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। সাধু ওই পাকুড়গাছের নিচেই ধ্যানরত অবস্থায় মারা গিয়েছিল। সেই থেকে ওই খাঁচা ওখানেই পড়ে আছে। তবে খাঁচাটি ইঁদুরদের দখলে থাকে সব সময়। অতিথি পাখিদের জন্য তৈরি করা সব ঘর বনের দুষ্ট ইঁদুর আর বাদুড় মিলে নষ্ট করে দিল। পরবর্তী বছর বৈশাখে যখন ফল পাকা শুরু হলো তখন দূর-দূরান্ত থেকে পাখিরা আবার খুশিমনে বউ-বাচ্চা নিয়ে গোলাপজাম বনে এলো। বনে এসে তারা তাদের প্রিয় বন্ধু কাঠঠোকরা ও টুনিকে অনেক খুঁজেও পেল না। আগের বছরের অতিথি পাখিদের জন্য বানানো থাকার ঘরগুলো দেখে তারা অবাক হলো। সব ঘর ভাঙা, নষ্ট। অতিথি পাখিরা এই নিয়ে যখন চিন্তিত, তখন ইঁদুর কলাবাদুড় এবং কলাবাদুড়ের অন্য বন্ধুরা মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করে বসল। এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে অতিথি পাখিরা ফল না খেয়ে মনে দুঃখ নিয়ে ফিরে গেল। ইঁদুর, কলাবাদুড়রা মিলে আর কতই-বা গোলাপজাম খাবে? তাই ফল খেতে আশপাশের বন থেকে বাদুড়ের আরও জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে খবর দিয়ে আনা হলো। তবু সবাই মিলে এত গোলাপজাম খেয়ে শেষ করতে পারল না। সেই বৈশাখে শত শত গোলাপজাম গাছের নিচে পচে গেল। জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে না আসতেই গোলাপজাম গাছ পুরোপুরি খালি হয়ে গেল। আর একটি গোলাপজামও গাছে রইল না। দুষ্ট ইঁদুর ও বাদুড় বন্দিদশা থেকে কাঠঠোকরা ও টুনিকে মুক্তি দিল। মুক্তি দেওয়ার আগে জোর গলায় শাসিয়ে দিল, যেন তারা আর বাইরের পাখিদের জন্য বাসা না বানায় এবং বনের বাইরের কোনো পাখিকে যেন গোলাপজাম খেতে আমন্ত্রণ না জানায়। ইঁদুর ও বাদুড়ের কথায় পরোপকারী কাঠঠোকরা ও মোচাটুনি কিছু বলল না। মনে কষ্ট নিয়ে চুপ করে রইল। কিছুদিন পর আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি বনে প্রচ- ঝড় উঠল। ঝড়ে বনের প্রচুর গাছ পড়ে গেল। পড়ে গেল বট, ছাতিম, আম, রেইনট্রি, গগন শিরীষ, নারিকেল, সুপারি, খেজুরসহ অনেক গাছ। পুরো বন ল-ভ- হয়ে গেল। বনের প্রাচীন আমগাছটিও পড়ে গেল। যেখানে ছিল ইঁদুরের বাড়ি। ভোরের দিকে ঝড় থেমে গেলে ইঁদুর ছেলেমেয়ে নিয়ে কাঠঠোকরার কাছে গিয়ে তার পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে বলল ভাই, আমাকে মাফ করে দাও। তোমাদের সাথে অন্যায় করেছি। আমার বাড়ি ঝড়ে ভেঙে গেছে। আমাকে আজই একটি বাসা বানিয়ে দাও। বাদুড়ও ইঁদুরের সাথে আছে। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। সে চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঠঠোকরা বলল, সব বাড়ি তো নষ্ট করে দিয়েছ। এই বিপদে যাদের ঘর ভেঙে গেছে তারা ওইসব বাড়িতে থাকতে পারত। তুমিও একটি বাড়িতে থাকতে পারতে। কত কষ্ট করে আমি আর টুনি বাড়িগুলো বানিয়েছিলাম। ইঁদুর আবার পায়ে পড়ে বলল ভাই, ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দাও। ভবিষ্যতে আর তোমাদের কাজে বাধা দেব না। তোমরা বনে আবার বাসা বানাবে। অতিথি পাখিরা বৈশাখে আবার গোলাপজাম খেতে আসবে। আমি ও বাদুড় আর নিষেধ করব না। বিশ্বাস করো আমাদের। আমার বাচ্চাগুলো কাল সারারাত ভিজেছে। একজনের গায়ে জ্বরও এসেছে। এই বিপদে আমাকে একটু সাহায্য করো ভাই। বাদুড় এবারও কিছু বলল না। কাঠঠোকরা খেয়াল করল ইঁদুরের একটি ছেলে জ্বরে কাঁপছে। বেচারা বাচ্চাটির জন্য কাঠঠোকরার খুব মায়া হলো। কাঠঠোকরা বলল, চিন্তা করো না। দুপুরের আগে তোমার বাসা হয়ে যাবে। তবে একটি শর্ত আছে। আগামী বৈশাখে যখন গোলাপজাম পাকা শুরু হবে এবং অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করবে তখন গোলাপজাম বনের মাঝখানের মরা গাছের গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে তোমরা দুইজন প্রত্যেক পাখিদের স্বাগত জানিয়ে সালাম ঠুকবে। যদি এই শর্তে রাজি থাকো তবে তোমার ঘর করে দেব। বিনা বাক্যে ইঁদুর রাজি হয়ে গেল। কাঠঠোকরা বাদুড়ের দিকে তাকিয়ে রইল বাদুড় কী বলে শোনার জন্য। বাদুড়ও নিমরাজির মতো করে আস্তে বলল, ঠিক আছে। কাঠঠোকরা সাথে সাথে ইঁদুরের জন্য বাসা বানাতে বের হয়ে পড়ল। দুপুরের আগেই বনের উত্তরে একটি বড় তালগাছের নিচের দিকে কাঠঠোকরা তার বাটালি ঠোঁটে ইঁদুরের জন্য একটি সুন্দর বাসা তৈরি করে ফেলল। ইঁদুর নতুন বাসা পেয়ে যারপরনাই খুশি হলো।