বিশ শতকের গোড়ার দিকে, ‘অবনী ছবি লেখে’- রবীন্দ্রনাথের এমনতর মন্তব্য এখনও মুখে-মুখে ফেরে। অবনীন্দ্রনাথ ছবি-আঁকিয়ে শিল্পী, সেই সঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘ছবি’ নিয়ে ‘লেখা’- অবিস্মরণীয় প্রবন্ধমালা। একুশ শতকের গোড়ায় আমাদের হাতে এসেছে ‘চারুকারু সংবেদ’ নামের একটি অবিস্মরণীয় গল্পগ্রন্থ। কথাশিল্পী জায়েদ ফরিদ এখানে গল্পের উপাদান হিসাবে নিছক চারু-ও-কারুশিল্পকে বেছে নেননি, সেই সঙ্গে নিয়েছেন শিল্পকর্মে নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীমানব-মানবীর হৃদয়সংবেদন। চারু ও কারুশিল্প যেখানে মাধ্যম হিসাবে জড়বস্তুকে উপায়-উপাদান হিসাবে নিয়েছে, গল্পকার জায়েদ ফরিদ সেখানে ভাষামাধ্যম ব্যবহার করে সংযুক্ত করেছেন জড়শিল্পস্রষ্টা শিল্পীদের জীবন্তজীবন। এমন সংযোজন চারুকারু-কথাশিল্প দুই শিল্পকেই প্রাণিত করে। গল্পকার তাঁর সমধিক অনুরাগে শিল্পীর মন-মনন-মানসজাত গহন প্রেমবোধের শিল্পরূপ দিতে চেয়েছেন গল্পে। কেবলই প্রেম-কাহানির কাঙ্গাল নন, বাঙালি সমাজের উচ্চ-মধ্য-নিম্নশ্রেণি নয় শুধু, মানবেতর অচ্ছুৎ সমাজের খাঁচাবন্দি মানুষের দুয়ারে মানবপ্রেমের বাণী কথাশিল্পের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন... এখানেই তাঁর মোক্ষলাভ। জায়েদ ফরিদের প্রতিটি ছোটোগল্পেই তাঁর বাক-পরিমিতিবোধ এবং মানবীয় প্রেমের ধ্রুপদ-স্পন্দন স্পন্দিত হতেই থাকে। আপন বৈদগ্ধ্যের কুঠুরির দুয়ার খুলে, পাঠক, এ গ্রন্থপাঠের মূল্য হৃদয়ঙ্গম করার আনন্দে বিভোর হতে পারবেন। কুয়াত ইল ইসলাম সাহিত্য সম্পাদক
জন্ম ১৯৪৮ সালে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে এক বিমিশ্র প্রাকৃতিক ঠিকানায় যার সামনে পদ্মা, পেছনে যমুনা, মাঝখানে কাশবন, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এবং বন-জঙ্গল। গাঙ্গেয় শুশুকের সঙ্গে সাঁতার কেটে আর বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বড় হয়েছেন তিনি। শৈশবের দুরন্ত জায়েদের প্রথমপাঠ পাবনায় শুরু হলেও পরবর্তীকালে পিতার চাকরিসূত্রে আরণ্যক যশোরে অবস্থান করেছেন প্রায় একযুগ। অতি-কৈশোরেও তৎকালীন যশোরের উদ্ভিদজগৎ, সাধুসন্তদের চিন্তাধারা ও লালনগীতি তাঁর জীবনবোধকে স্পর্শ করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন তিনি। পেশাগত জীবনে মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদের বিজ্ঞান জাদুঘরে প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল কিউরেটর হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় দু-দশককাল। বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি দেশের প্রকৃতিকে গভীরভাবে অন্তরে ধারণ করে আছেন। ছুটিতে দেশে এসেই নিসর্গীদের নিয়ে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়ান বৃক্ষজগতের অলিগলিতে। বিদেশের খণ্ড-অবসরে তিনি রাইটার্স নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কয়েক বছর, বিজ্ঞান চর্চা করেছেন, গল্প-কবিতা লিখেছেন। প্রচারবিমুখ, বন্ধুবৎসল এই মানুষটির অনেক অদ্ভুত স্বভাব সম্পর্কে জানা যায়। দীর্ঘ যানজটেও কখনো ক্লান্ত হন না, চোখ তখন নিবিষ্ট থাকে রাস্তার পাশে বা সড়কদ্বীপের গাছগুলোর দিকে। প্রকাশনার পর কখনো নিজের বইয়ের খবর রাখেন না, মনে করেন পুস্তকের যাবতীয় অধিকার পাঠকের। খেয়ালি এই নিসর্গীর আরেকটি স্বভাব হলো উদ্ভিদসংক্রান্ত বিচিত্র তথ্য-সংগ্রহ করে তা অন্যদের অবহিত করা। জীবন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও উদ্ভিদের মেলবন্ধনে জায়েদ ফরিদের অবদান অনস্বীকার্য। এই সদালাপী, নিরহংকার মানুষটির পথচলা সরল ও নিরবচ্ছিন্ন হোক, আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।