এই রচনার মূল গাঁথুনি গড়ে উঠেছে ডা. তনিমা নামের এক গাইনোকোলজিস্টকে ঘিরে কাহিনির চলমানতার জন্যে তনিমার সাথে এসেছে ডা. শোভন, ডা. শেলী আর ডা. তন্ময় চরিত্রগুলো। তবে ডা. তনিমাই এই উপন্যাসের প্রাণপৈতি। এই উপন্যাসের যাবতীয় আলো পড়ে এই ডাক্তারটির ওপর। এই চরিত্রটিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সার্বিক ঘটনাপ্রবাহ। করোনা সময়ে গগনচুম্বী ইমারতের কার্নিশে ঝুলে ঝুলে পেশাগত দায়িত্বপালন করা রঙমিস্ত্রির কাজের চেয়েও বিপজ্জনক পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ডাক্তারি করা। একটুখানি বেখেয়াল বা উন্মনা হলেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি। সৃষ্টি স্থিতির কোনো পর্বে পৃথিবীতে করোনা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো রোগ আসেনি যে রোগে আনুপাতিক হারে ডাক্তার মরেছে সবচেয়ে বেশি। ডাক্তার-নার্সদের ঘাড়ের ওপর ঝুলে আছে মৃত্যু নামের ভয়দ খড়গ কিন্তু তারপরও হাসপাতাল বন্ধ হয়নি কখনো। স্কুল বন্ধ, কলেজ বন্ধ, মন্দির বন্ধ, মসজিদ বন্ধ, মিটিং-মিছিল সব বন্ধ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ, অফিস-আদালতে তালা কিন্তু হাসপাতালের দরজা খোলা থেকেছে অহোরাত্র। মৃত্যুভয়ে শব দাহ করা পালিয়ে গেছে শ্মশান থেকে, করোনা লাশের স্পর্শ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গোরস্থান থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেছে গোরখোদকরা কিন্তু করোনার ভয়ে হাসপাতাল থেকে ডাক্তার-নার্স পালিয়ে গেছে এমন কথা কেউ কি শুনেছে কখনো? মৃত্যুর শাসানিকে ডাক্তাররা আমলে নেয়নি, তোয়াক্কা করেনি অণুমাত্র । এই ডাক্তাররা করোনা রোগীর চিকিৎসা আর অপারেশন করতে গিয়ে নিজে যে এ থেকে মরে যেতে পারে, ওই ভাবনাকে গ্রাহ্যই করেনি আর ধর্তব্যের মধ্যেও আনেনি কখনো। পেশার প্রতি সত্যবদ্ধ নারী ডাক্তাররা কী করে তাদের নিজ নিজ জীবনকে তৃণজ্ঞান আর বিঘ্নসংকুল করে রোগীর মোক্ষদাত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল করোনা সময়ে, তারই এক ধারাবহ বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এই রচনায় । এটি প্রথা ভাঙা কোনো আখ্যান নয়, সময় ও স্মৃতি আর করোনাকালের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাই এই উপন্যাসের একমাত্র উপকরণ। করোনা সময়ের এ এক বিরল বিন্যাস, যা যুগপৎ নৈর্ব্যক্তিক ও বাস্তব। কোনো কিছুতেই অতিশয়তা নেই, কোনো বিষয়েরই অতিরেক প্রকাশ নেই। এই উপন্যাসে রয়েছে যথাস্থানে যথার্থ শব্দটি চয়নের নিরন্তর অনুশীলন। রোমান্স ও ট্র্যাজেডির যুগ্ম প্রকাশ আছে এই রচনার প্রতি পর্বে। করোনা দহনকালের আগুন-অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি, কাহিনি সংস্থিতি, রোমান্সের অনিবার্যতা, গাঢ় হৃদয়াবেগ, নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা সার্থকভাবে ফুটে ওঠে এই উপন্যাসে। করোনা সময়ের উপায়ান্তরহীন নড়বড়ে পৃথিবীর রূপ, বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, অসহায়ত্ব আর অসারত্ব, বিপন্ন মানুষের আর্তি, হতপ্রায় মধ্যবিত্তের বিপন্ন জীবনের আত্মভাব, সবকিছু যেন বাস্তবতার নিরিখে আর লেখকের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মূর্ত হয়ে ওঠে পাঠকের চোখের সামনে। করোনা দহন যেন যথার্থতা নিয়ে উঠে এসেছে এই লেখার ভাঁজে ভাঁজে। করোনা মধ্যবিত্তের গোনা টাকার নিগড়ে বাঁধা জীবনচর্চাকে যারপরনাই বিষিয়ে তুলেছিল চূড়ান্তভাবে। রাস্তার লকডাউনের সাথে লকডাউন নেমে এসেছিল মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে। অফিস আর কলকারখানার সিংহদরজায় তালা, চাকরিজীবীদের কাঁধের ওপর ছাঁটাইয়ের খাঁড়া, অর্ধেক বেতন কিংবা বিনা বেতনে চাকরি করার প্রাণান্তকর পরিক্লেশ পরিবেদনা ও অনলদগ্ধ গোঙানি আর মধ্যবিত্তের জীবনের নিকষকালো হতাশা সবকিছু রুপোলি পর্দার ছায়াদৃশ্যের মতো ঝুলে আছে এই রচনার পাতার পাতায়। উচ্চবিত্তের জীবনের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি, মধ্যবিত্তের কোনোমতে বেঁচেবর্তে থাকার মর্মন্তুদ সংগ্রাম আর নিম্নবিত্তের নির্বোধ অসহায়তা এবং তাদের জঠরজ্বালা নিবারণের বৈকল্পিক সরণি অন্বেষণের অনুভূতিঋদ্ধ সংবেদী বিষয়-আশয়ের সার্থক প্রতিফলন আছে এই উপন্যাসে। এই উপন্যাসের পরতে পরতে রোমান্টিকতার ছোঁয়া থাকলেও লেখকের অনন্য বর্ণনে করোনা দহনকালের আত্যয়িকতার দুর্বহ রূপটি কখনো ফিকে হয়ে যায় না। শব্দ ও বাক্যের ধোঁয়াটে ব্যবহার এই লেখকের সহজাত লিখনশৈলী। অনেক কথাই তিনি স্পষ্ট করে বলেন না, যা তিনি বলেন না সেইটুকু নিজের বোধি আর প্রতীতি দিয়ে বুঝে নিতে হয় পাঠককে। এককথায় করোনাকালের বহুস্তরী অস্থির বাস্তবতাকে কালি ও কলমে ধরে রাখার এক অনন্য প্রয়াস আছে এই উপন্যাসে। ডা. তনিমা নামের এক অদম্য সাহসী গাইনোকোলজিস্টের যাপিত জীবনের অন্ধিসন্ধি আর করোনা দহনের বিপ্রকৃত বিপর্যস্ত অন্তহীন রূঢ় প্রশ্নের আকর অস্তিত্ব শিল্পে উত্তরিত হয়েছে এই রচনায়। সব মিলিয়ে বরেন চক্রবর্তীর লেখা ‘করোনাকালে প্ৰেম' বিপৎকালীন সময়ের অনুভূতি জারিত এক নিঃস্বর নাটক। (এটি লেখকের করোনা ট্রিলজি গ্রন্থমালার দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অনিন্দিতার করোনা যুদ্ধ' শিরোনামে।)