বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মাহুতি, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং গুটি কয়েক ঘাতক-দালাল বাদে আপামর জনগণের আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা পায়। গৌরব এবং বেদনায় মহিমান্বিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তা কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করেছে। আত্মদানের রয়েছে সহ¯্র মর্মন্তুদ কাহিনী, সাহসের সব অমৃতকথা, নির্যাতন বরণের অগণিত কথকতা। জাতির প্রয়োজনে, সময়ের আহ্বানে আমাদের সমাজের অতি সাধারণ স্তরের মানুষও সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিয়ে পরিণত হয়েছেন অসাধারণ মুক্তিযোদ্ধায়। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে এক অপরূপ মুক্তিযুদ্ধের উত্থান। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে মুক্তিপাগল জনগণ গড়ে তুলেছিলো অপ্রতিরোধ্য ঐক্যবদ্ধ কালজয়ী সংগ্রাম। কতোভাবে যে প্রতিরোধকামী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা! সেজন্য কতো যে কষ্ট ও নির্যাতন বরণ করতে হয়েছে তাদের! ঘরে ঘরে কতো সহ¯্র মা অভাবের মধ্যেও কতো অচেনা সন্তানদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার জুটিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে গিয়ে প্রাণও দিয়েছেন অনেকে। শহরের মানুষেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বিপুল সংখ্যায় গ্রামের পানে ছুটেছে; গ্রামবাসীরা হৃদয় দিয়ে, সবটুকু সাধ্য দিয়ে তাদের বরণ করেছেন। ভারতে শরণার্থী হয়েছে কোটি মানুষ। কী এক অসহনীয় অমানবিকতায়, ক্ষুধায়, অসুখে কতো অজ¯্র মানুষ ভুগেছে, মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মানবিক পৃথিবী, বিশেষত ভারতের সরকার ও জনগণ। বেদনা, গৌরব আর বীরত্বের মহাকাব্য আমাদের সুমহান মুক্তির সংগ্রাম। কতো ধরনের গৌরবগাথা, যার অধিকাংশ আমরা জানতে পারিনি, কোনোদিন জানতেও পারবোনা। তবুও যতটুকু জানি, তার সামান্য অংশও যদি লিপিবদ্ধ করে রাখা যায়, সেটাকেও আমরা মহামূল্যবান মনে করি। এই লক্ষ্য থেকেই নেওয়া হয়েছে প্রকাশনার এক বিশেষ উদ্যোগÑ মহান মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার সিরিজ সংকলন ‘আমার একাত্তর’। মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট এই সংকলন প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। উদ্যোগ গ্রহণের পেছনে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মাহবুব জামান, সম্পাদক মুহম্মদ হিলালউদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ কামরুজ্জামান ননী ও সভাপতি শেখর দত্ত। বাংলা ধরিত্রীও ছিল এই উদ্যোগের সঙ্গে। প্রথম খ-টি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। দ্বিতীয় খ-টিও রয়েছে প্রকাশের অপেক্ষায়। সংশ্লিষ্ট সকলের কাছ থেকে আমরা লেখা চাই। সকলের ‘আমার একাত্তর’-এর ভেতর দিয়ে গড়ে উঠবে ‘জাতির একাত্তর’, যা হবে আমাদের জাতির চির প্রেরণার উৎস। সংকলন পড়ে যদি পাঠক, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুব্ধ হন, দেশ-জাতি-জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন, তবেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।