সমকালীন বাংলা দেশের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক কবি অমিয় চক্রবর্তী। অবশ্য কবিতামাত্রেই মানুষের আত্মা থেকে উদ্ভূত, আর সেই হিশেবে প্রত্যেক কবিরই ঐ বিশেষণটিতে অধিকার আছে; কিন্তু আমি এখানে একটি বিশেষ অর্থে 'আধ্যাত্মিক কথাটা প্রয়োগ করতে চাই। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় একটি আশ্চর্য বৈদেহিকতা ব্যাপ্ত হ'য়ে আছে, রক্তমাংসের আক্রমণ সেখানে সবচেয়ে কম: ইন্দ্রিয়চেতনার কবি জীবনানন্দর সঙ্গে তাঁর বৈপরীত্য যেমন মেরু প্রমাণ, তেমনি সুধীন্দ্রনাথের দ্বন্দ্বরক্তিম মানসও তাঁর সুদূরবর্তী। তাঁর যে-কবিতাটি প্রথম সাড়া তুলেছিলো সেটি মনে করা যাক: 'সংগতি', ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার মিলন-সংগীত; এই সংগতি তাঁর সকল কাব্যের মূলমন্ত্র। এই 'হাঁ-য়ের দেশ থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিলো, যেখানে আমরা কেউ-কেউ দীর্ঘ ভ্রমণেও ঠিকমতো পৌঁছতে পারিনি, কিংবা স্পর্শ ক'রে থাকলেও টিকে থাকতে পারিনি যেখানে। এটাই তাঁর রচনার প্রেরণা এবং অন্তঃসার: অভাব, প্রশ্ন, তর্ক, বোমা-ভাঙা শহর, বাংলার দারিদ্র্য, মার্কিন সভ্যতা,প্রেমিকার বিচ্ছেদ,- এই সব কণ্টকময় জটিলতা একটি স্থির 'হাঁ-ধর্মের অন্তর্ভূত হয়ে আছে; রক্তবীজের মতো 'না-য়ের গোষ্ঠী গজিয়ে উঠলেও তারা এক আরো বিরাট পরিকল্পনার মধ্যে সুষমভাবে, বিনীতভাবে অবস্থান লাভ করছে, কোনো দুর্জয় বিরোধের জন্ম দিতে পারছে না। এক দিকে তাঁর স্বভাবের আপতিক বহির্মুখিতা, অন্য দিকে তাঁর আস্থার নৈষ্ঠিকতা- এই দুটি কারণে, অন্যান্য বিষয়ে যতই গরমিল থাক, তাঁর সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য ধরা পড়ে সমসাময়িকদের মধ্যে একমাত্র বিষ্ণু দে-র। অবশ্য এই সাদৃশ্য অতিশয় সুকুমার, কোনোরকম সূক্ষ্ম বিচার তার সহ্য হবে না; যেমন দু-জন অনাত্মীয় বা ভিনদেশী মানুষের চেহারায় দৈবাৎ মিল দেখা যায়, কিন্তু নড়াচড়া বা গলার আওয়াজেই ভুল ভাঙতে দেরি হয় না।
অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম: এপ্রিল ১০, ১৯০১ - মৃত্যু: জুন ১২, ১৯৮৬) বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে'র সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নাম অবিনাশী বন্ধন ও সমসাময়িকতার বিস্ময়ে জড়িয়ে আছে। শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি এবং সৃজনশীল গদ্যশিল্পী অমিয় চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন। অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সেই সময় জর্জ বার্নাড'শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, কবি ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পাস্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রভৃতি বিখ্যাত মনীষীর সান্নিধ্যে আসেন।