একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ এবং সকল বিবেচনায় জনযুদ্ধ ছিল। গণহত্যা, শরণার্থী শিবির, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থন/বিরোধিতা, দেশ-বিদেশের ভূমিকা, সর্বোপরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ফসল স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী বাংলাদেশ। এর প্রতিটি বিষয়ে অদ্যাবধি স্মৃতিচারণ ও বিশ্লেষণধর্মী কয়েক হাজার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই একান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। প্রায় এক কোটি মানুষ গণহত্যার মুখে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য দেশত্যাগ করে। কিন্তু কতিপয় কুলাঙ্গার পাকবাহিনীর দোসর ছাড়া অবরুদ্ধ দেশে অবস্থানরত ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সার্বিক সমর্থন ছাড়া লক্ষাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর পক্ষে নয় মাসে এ বিজয় অর্জন সম্ভব হতো না। অসীম সাহসী এই অবরুদ্ধ দেশের যোদ্ধারা সকল ঝুঁকি নিয়ে সুকৌশলে এই জাতীয় কর্তব্য সাধন করেছেন। লেখক কাজী ফেরদৌসী লিনু হক রাজধানী ঢাকায়, আরও সুনির্দিষ্টভাবে তার পরিবারের বাসস্থান আজিমপুরের এই যোদ্ধাদের নিয়ে গভীর আন্তরিকতার সাথে তার ইতিবৃত্ত 'অবরুদ্ধ নগরের গেরিলা ৭১' পুস্তকটি প্রকাশে ব্রতী হয়েছেন। প্রধানত যে দুই জন মুক্তিযোদ্ধার কার্যক্রম লিপিবদ্ধ হয়েছে, তাদের একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষিত হয়েছেন। বইটি পাঠকালে এটি লক্ষ করেছি যে, লেখক নিজস্ব ভূমিকা লিপিবদ্ধ করেছেন কিন্তু আত্মপ্রচারে অনাগ্রহী রয়ে গেছেন। পুস্তকের দ্বিতীয় অংশে অপর একজন প্রচারে অনাগ্রহী সাহসী মুক্তিসেনার কাহিনি বিবৃত হয়েছে। তিনি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, অবরুদ্ধ দেশে অন্যদের প্রশিক্ষিত করেছেন, ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা দয়াগঞ্জ, পোস্তাগলা ও ডেমরায় মিত্রবাহিনীর পরামর্শ ও সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। এই লেখকের পূর্ববর্তী পুস্তকে তিনি একইভাবে অবরুদ্ধ নগরীর ঘটনাবলি প্রকাশ করেছেন। উভয় গ্রন্থেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় অপর একটি মৌলিক বিষয় সচেতনভাবে উল্লেখ করেছেন, যেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান। সাধারণভাবে এ বিষয়ে একটি image fixation' রয়ে গেছে। যেহেতু বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা মধ্যযুগীয় কায়দায় সারা দেশব্যাপী নারী নির্যাতনে লিপ্ত হয়েছে, অথচ পাশবিক নির্যাতন উপেক্ষা করে সারা দেশে নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে, যুদ্ধাস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। আর এই গ্রন্থের রচয়িতা মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনে ঢাকা নগরের নারীরা যে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন, তার চিত্র তুলে ধরেছেন। আমার বিশ্বাস, এই গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস রচনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আশা করছি, এ পুস্তক বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকপ্রিয়তা লাভ করবে।