'উপন্যাস শুধু বিনোদন নয় শিক্ষারও এই সত্যতা ফেরদৌস হাসানের অন্যান্য উপন্যাসের মতো বর্তমান উপন্যাস বাতাস আর পাখির মতো-তেও বিদ্যমান। 'একই অঙ্গে অনেক রূপ'-এর মতো একই ফেরদৌস হাসান-এর অনেক গুণ। তিনি একাধারে নাট্যকার, নাট্যনির্মাতা, সুরকার, গীতিকবি, সংগীত শিল্পী এবং কথাশিল্পী। কয়েক হাজার টেলিভিশন নাটক রচনা এবং পরিচালনার পাশাপাশি বাংলা উপন্যাসেও এতদিনে তিনি সুদৃঢ় অবস্থান করে নিয়েছেন আপন প্রতিভায়। ইতোমধ্যে তাঁর প্রায় অর্ধশত উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের ব্যপক সাড়াও মিলেছে তাতে। নিজস্ব ভাষাশৈলী, মোহময় বর্ণনভঙ্গী, মুনশিয়ানাপূর্ণ বয়ান-কৌশল আর কাহিনির জাদুকরি বোনট ফেরদৌস হাসানের গদ্যকে মহিয়ান করে তুলেছে। উপন্যাসের মূল উপজীব্য যে মানুষ আর সেই মানুষের জীবন ফেরদৌস হাসানও সেই উপজীব্যকে পুঁজি করেই তাঁর উপন্যাসের আখ্যান প্রসারিত করেন। তবে নিজস্ব সৌকর্যে সেই আখ্যানের ভাজে ভাঁজে প্রোথিত করেন স্বদেশপ্রেম, নীতিবোধ, মূল্যবোধ, সুবচন, সুচিন্তা আর মানবিক মূল্যবোধের পুষ্পবীজ। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন অবলম্বনে নির্মিত আখ্যান আর সাধারণ থাকে না। বিস্ময়কর শিল্প-সৌকর্য আর অসাধারণ শৈলী-সৌন্দর্যে তা হয়ে ওঠে আরও অসাধারণ, আরও অনন্য। পাঠককে যা অনায়াসেই মুগ্ধ করে, বিমোহিত করে, জাগ্রত করে, আশান্বিত করে। বাতাস আর পাখির মতোও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে দামী ফুটবলার রোনালদো-ভক্ত গল্পের কথক সাজ্জাদ সাদ-এর আত্মকথনের মাধ্যমে উপন্যাসের সূচনা হলেও মোহনীয় ফ্ল্যাশব্যাকের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ঔপন্যাসিক কোন পলকে যে পাঠককে অতীতে টেনে নিয়ে যান। পাঠক টেরও পায় না। সেই অতীতে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করে দেশের সর্বোত্তর-জনপদ রাজশাহীতে; স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের অস্থির সময়ে। যেখানে কিছুসংখ্যক অসৎ, লোভী, মোহাচ্ছন্ন সমাজতন্ত্রী কমরেডদের তথাকথিত বিপ্লবী চেতনার দ্বন্দ্বে মৃত্যু ঘটছে দারুণ সম্ভাবনাময়ী তরুণ ফুটবলার সাজ্জাদ সাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী বাবার ক্ষমতা লিপ্সার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কিশোরী নীলুর নিষ্পাপ ভালোবাসা। বাতাস আর পাখি ছাড়া আর সবাই হারিয়ে ফেলছে আপন স্বাধীন ভূখণ্ডে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার। সেই ভীতিকর অস্থির সময়ে ইলামিত্রের মতো আর এক মহিয়সী সাহসী মা বিপ্লবীদের মুখোমুখি দাঁড়ান। তাঁর বুকে স্বাধীনতার অদম্য শক্তি, মুখে সাহসী প্রতিবাদ : 'আমরা বাতাস আর পাখির মতো বাঁচবো।' সেই জীবমন্ত্রে পাঠকও দীক্ষা নেয়। কোন অজ্ঞাতে, নিজেও জানে না। শাকির সবুর অধ্যাপক ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের নাট্যজগতে ফেরদৌস হাসান এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। নাট্যকার হওয়ার কারণে তাঁর লেখা কাহিনীতে থাকে ব্যাপক মােচড়। তাঁর উপন্যাস পড়লে ঢুকে যেতে হয় মায়াবী ইন্দ্রজালে। ফেরদৌস হাসান তৈরি করেছেন এক নিজস্ব গল্প বলার ঢঙ। তার লেখা উপন্যাস বা তার তৈরি নাটক দেখলে অনায়াসেই বুঝে ফেলা যায়, এই নাট্যকার বা ঔপন্যাসিকের নাম। বানিয়েছেন পাঁচ হাজারেরও বেশী নাটক। লিখেছেন প্রায় অর্ধশত গল্প, উপন্যাস। নাটকশীতের পাখি, সেই এক গায়েন, ঝুমকা, তেমনি আছি, আমি শিমুলের কাছে, আমার কেবলই রাত হয়ে যায়, একটি নীল জামা, ঝরা পাতাটুকু, নক্ষত্র দিনের গল্প, সাদাকালাে তাঁরই অমর সৃষ্টি। ধারাবাহিক নাটকগুলাের মধ্যে কয়েকটি হল ফেরা, শ্যওলা, সম্পূর্ণ রঙিন, মহানগর, প্রজাপতি দিন, প্রতিদিন একটি গােলাপ, অন্ধকারের ফুল, বন্ধু আমার, মায়া। ইত্যাদি অবিস্মরণীয় । জনপ্রিয় উপন্যাসগুলাের মধ্যে রয়েছে। তােমার বসন্ত দিনে, আমার কেবলই রাত হয়ে যায়, এখানে তােমার আকাশ, বুকের কাছে জল, মায়া, ভালবাসি, সে আমার একলা পাখি, সে অসীমা বলে পাইনি, ঝরা পাতা টুকু। আশির দশক থেকে লিখে আসা তাঁর রচনায় সমসাময়িক বিষয় উঠে আসে চমৎকার নৈপূণ্যতায় । ব্যক্তিজীবনে খুবই সহজসরল জীবনযাপন করেন ফেরদৌস হাসান । বিশ্বাস রাখেন স্রষ্টায় আর খুঁজে বেড়ান তাঁর সান্নিধ্য।