১৬.৯.১৯৭৩ থেকে ১৬.১২.১৯৭৪ পর্যন্ত সময়ে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত রাজনৈতিক ভাষ্যগুলি Towards the Emergency (আগস্ট ১৯৮০) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। বদরুদ্দীন উমর গ্রন্থটির ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘এমন একটি সময়ে রচনাগুলি লিখিত এবং প্রকাশিত হয়েছিল যখন শেখ মুজিবুর রহমান পরিচালিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং সরকার চরম সংকটে (point of no return) পতিত। দ্রুত এমন একটি অবস্থা ঘনিয়ে আসছিল যে অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র অথচ সাময়িক যে পথটি খোলা ছিল তা হলো জরুরি অবস্থা জারি। সংবিধানে আগে থেকে জরুরি অবস্থা জারির সুযোগ সুরক্ষিত হয়েছিল। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ তারিখে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। ক্ষমতাসীন পার্টি আওয়ামী লীগ ব্যতিত সকল রাজনৈতিক দল অবৈধ ঘোষিত হলো। অধিকাংশ সংবাদপত্র বন্ধ করা হলো, অবশিষ্টগুলি সরকারী আওতায় আনা হলো। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে সভাপতি করে বাঙলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে এক নোতুন ‘সমাজতন্ত্রী’ দল ঘোষণা করলেন, সত্ত্বর একদলীয় সরকারের আবির্ভাব ঘটল। এ দলে রইল আওয়ামী লীগ, মস্কো পন্থী বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই ‘সমাজতান্ত্রিক’ দলটি রইল সকলের জন্য উম্মুক্ত - আমলা, সামরিক বাহিনীর সদস্য ইত্যাদি। ক্রমাগত চাপও থাকল সকল শ্রেণীর মানুষের উপর দলে যোগদানের। এই জরুরি আইন জারির মাধ্যমে অত্যাচার নিপীড়ন এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাল যাকে তুলনা করা যায় কেবল ২৫ মার্চ - ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সময়কালে পাকবাহিনীর শাসনের সাথে। এই জরুরি অবস্থায় বহু বিপ্লবী এবং গণতন্ত্রীকে হত্যা করলো সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর গুণ্ডারা এবং ক্ষমতাসীন দলের আওতাধীন অনিয়মিত বাহিনী। হাজার হাজার গ্রেপ্তার করা হলো। ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ায় বহু পরিবার গৃহহারা হলো। দেশের মানুষের জীবন সর্বক্ষেত্রে অসহনীয় হয়ে উঠল। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাঙলাদেশ সেনাবাহিনীর একাংশ মার্কিন সহযোগিতায় কুদেতা ঘটালো, শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার পরিজনসহ নিহত হলেন। তাঁর ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বাকশালও ছিন্নভিন্ন হয়ে বিলুপ্ত হলো। ... পাঠক এ গ্রন্থে সে সময়ের ইতিহাস পাবেন না কিন্তু সে সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার সাথে পরিচিত হতে পারবেন।’ (’Preface’ : বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী : খণ্ড ৬ : পৃ ১১) আমাদের ভাষার লড়াই (প্রথম প্রকাশ ১৯৮১) হলো ‘ছোটদের জন্য ছোট আকারে ভাষা আন্দোলনের একটি ইতিহাস। ... এ বইটির আকার ছোটই হয়েছিলো, কিন্তু আকার ছোট হলেও এটা ঠিক ছোটদের উপযোগী কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিলো এবং এখনো আছে।’ (‘মুখবন্ধ’:উর:৬:১৪৪) বাঙলাদেশে মার্কসবাদ (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২) গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে উমর লিখেছেন, ‘বাঙলাদেশে মার্কসবাদী চিন্তা এবং শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে যে সব প্রবন্ধ লিখিত হয়েছিলো তার মধ্যে কতকগুলিকে নির্বাচন করে বর্তমান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’ (‘মুখবন্ধ’:উর:৬:১৩৩) কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জন্য একটি অবশ্য পাঠ্যগ্রন্থ বাঙলাদেশে মার্কসবাদ। বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২) গ্রন্থে প্রকাশিত রচনাগুলির বিষয়বস্তু সম্পর্কে উমর লিখেছেন, ‘এই বইয়ে সংকলিত প্রবন্ধগুলি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে লিখিত হয়েছিলো।... এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলিতে আলোচ্য সময়ের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস নেই। এগুলিতে বাঙলাদেশের বুর্জোয়া রাজনীতির এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতিরও কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিকের বিশ্লেষণ করা হয়েছে মাত্র। এই বিশ্লেষণ অবশ্য এমনভাবে উপস্থিত করা হয়েছে যাতে ধারাবাহিকভাবে এগুলিকে বিবেচনা করলে বাঙলাদেশের রাজনীতির এক বিশেষ পর্যায়ের একটি চিত্র মোটামুটিভাবে পাওয়া যেতে পারে।’ (উর:৬:৩০৩-৪) ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২) হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৪ সালে উমর প্রদত্ত ‘রাজা রামমোহন রায় মেমোরিয়াল লেকচার’। এ বক্তৃতা বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার এই বক্তৃতা কোনো গবেষণামূলক কাজ নয়। প্রকাশিত এবং পরিচিত তথ্যসমূহের ভিত্তিতেই আমি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারাগুলি এখানে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছি। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রেণী, আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক – এই তিনটি দ্বন্দ্ব কিভাবে ভারতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে নানা সংঘাতের মধ্যে দিয়ে বিকাশ লাভ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব কিভাবে অপর দুটি দ্বন্দ্বকে নিজের অধীনস্থ করার পরিণতিতে ভারত সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছে তারই একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা আমি এখানে উপস্থিত করেছি।’ (‘মুখবন্ধ’:উর:৬:৪১৪) উপর্যুক্ত পাঁচটি গ্রন্থ বাঙ্গালা গবেষণা বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ৬-এ সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু বিভিন্ন কিন্তু সকল বিষয় একটি অন্তর্গত ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। সংশ্লিষ্ট সময়ে ভারতের এবং বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গ্রন্থগুলির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিম বাঙলার বর্ধমান শহরে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি বাঙলাদেশে সুপরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার আগেই ১৯৫৪ সালে দর্শন বিভাগে অস্থায়ীভাবে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে এম. এ. পাশ করার পর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি এই তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্ৰী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) তত্ত্বকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং তিনি নিজেই ১৯৬৮ সালে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।