বাঙ্গালা গবেষণা বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২ ও ৪-এ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড সংকলিত হয়েছে। এ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড সংকলিত হলো রচনাবলীর খণ্ড ৭-এ। রচনা প্রকাশের কালক্রম রক্ষার্থে এই বিন্যাস তৈরি হয়েছে। রচনাবলীর সম্পাদকীয়গুলিতে গ্রন্থটির খণ্ডসমূহের বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থটির তৃতীয় খণ্ডে পূর্ব বাঙলার শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘট, ছাত্র আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ-মুসলিম লীগ-আওয়ামী মুসলিম লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক পার্টির কার্যক্রম, নাজিমুদ্দিনের পল্টন বক্তৃতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। ২০শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২৩শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৪ দিনের আনুপূর্বিক বিবরণ রয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়, মার্চ-এপ্রিলের ঘটনাবলীসহ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বিষয়ে একটি পর্যালোচনা ইত্যাদি। স্ফূলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে – মাও সেতুঙের এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উমর লিখেছেন, ‘এই ধরনের দাবানলই আমরা সৃষ্টি হতে দেখি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়।’ (উর:৭:৩৪৬) কারণ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ‘ব্যাপক ও গভীরভাবে’ (ঐ:৩৪৫) পরিবর্তিত হয়েছিল। উমরের এই ত্রয়ীগ্রন্থ পাঠে ইতিহাসের সেই ব্যাপকতা ও গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ত্রয়ীগ্রন্থ আমাদের দেশের জনগণের ব্যাক্তিত্ব সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। এই দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এরকম একটি কাজের মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠী নিজেদের সফলসংগ্রামী হিসেবে আবিষ্কার করতে পারে এবং বৃহত্তর মুক্তির পথে অগ্রসর হবার ইন্ধন পায়। এ ক্ষেত্রে পেয়েছেও। একুশ আমাদের স্বাধীনতার পথ প্রদর্শন করেছে। শুধু তাই নয়, সেই স্বাধীনতার প্রকৃতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে - তা হলো জাতীয় গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা। ভবিষ্যতেও এই ত্রয়ীগ্রন্থ এতদাঞ্চলের মানুষের বৃহত্তর অগ্রযাত্রার চিত্তবীজ যোগান দেবে। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে কাজ করেছে ত্রয়ীগ্রন্থটি রচনায় উমর-ব্যবহৃত গবেষণা পদ্ধতি। উমর তার ইতিহাসটি উপস্থাপন করেছেন ঐতিহাসিকভাবে। ফলে বাহান্ন সালের মহা-আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গেছে ১৭৫৭ সাল পরবর্তী উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত। তাছাড়া ইতিহাসটি বর্ণিত হয়েছে দ্বান্দ্বিকভাবে। এর ফলে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ আন্দোলনের পরস্পর বিপরীত সংগ্রামশীল পক্ষসমূহ স্পষ্ট আকারে ব্যক্ত হয়েছে। ‘এই প্রক্রিয়ার একদিকে ছিলো, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দল ও তাদের শাসনের দ্বারা উপকৃত সুবিধাভোগী শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক – জমি মালিক, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী, আমলা, টাউট ইত্যাদি। অন্যদিকে ছিলো, কৃষক, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মেহনতি জনগনের সকল অংশ এবং বিপুল অধিকাংশ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী।’ (উর:৭:৩৪৬) এই দ্বান্দ্বিকতা আরও ফুটে উঠেছিল বিভিন্ন কার্যক্রমে। যেমন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র এবং যুবলীগ কর্তৃক ২১ তারিখে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্ম, ‘গণতন্ত্রী দল’ নামে একটি পেটিবুর্জোয়া অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ। কিন্তু কমিউনিস্টদের সঠিক বিশ্লেষণ ও কর্মপন্থা গ্রহণের অপারগতার কারণে পরে আন্দোলনের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে চলে যায়। বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কয়েকটি দিক (১৯৮৫) গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট সময়ের শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলন, বাম ও দক্ষিণ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলন ইত্যাদি চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। এ বিষয়ে উমর লিখেছেন, ‘পাকিস্তানী শাসনের শেষ পর্যায়ে ইয়াহিয়া খানের আমল, শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী-বাকশালী আমল ও জিয়াউর রহমানের আমলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির উপর বাঙলায় লিখিত প্রবন্ধের যে সংকলনগুলি ইতিপূর্বে যথাক্রমে যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ, যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ ও বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র নামে প্রকাশিত হয়েছে, বর্তমান সংকলনটিও প্রধানত এরশাদের সামরিক শাসন আমলের উপর সেই ধরনেরই একটি প্রবন্ধ সংকলন।’ (উর:৭:৩৯১) এগুলির অধিকাংশ রচিত হয়েছিল ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিম বাঙলার বর্ধমান শহরে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি বাঙলাদেশে সুপরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার আগেই ১৯৫৪ সালে দর্শন বিভাগে অস্থায়ীভাবে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে এম. এ. পাশ করার পর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি এই তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্ৰী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) তত্ত্বকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং তিনি নিজেই ১৯৬৮ সালে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।